ছায়াপুর
গ্রামের নামটা শুনলেই এক অদ্ভুত নির্জনতা যেন চারপাশ ঘিরে ধরে। “ছায়াপুর”—নামটার মধ্যেই আছে একটা রহস্যের ছোঁয়া। শহরের কোলাহল আর ধোঁয়া থেকে শত মাইল দূরে, একেবারে নিঝুম, নিরিবিলি আর ঘন সবুজে ঘেরা এই গ্রাম। শান্ত পুকুরের টলটলে জলে আকাশের ছায়া পড়ে, আর পাখির কলরব ছাড়া খুব একটা আওয়াজও শোনা যায় না এখানে। যেন সময় এখানে থমকে দাঁড়িয়ে আছে বছরের পর বছর।
গ্রামের মাটির পথটা সোজা চলে গেছে শেষ প্রান্তে— যেখানে ঘন জঙ্গলের আড়ালে আছে গ্রামের সবচেয়ে রহস্যময় জায়গা, বড়ি সাহেবের বাড়ি। বহু আগে এই বাড়িতে নাকি ইংরেজ আমলের এক সাহেব থাকতেন, গ্রামবাসীরা তাই নাম দিয়েছিল “বড়ি সাহেবের বাড়ি”। বাড়িটা দেখতে এখন পুরোটাই জীর্ণ—ধ্বসে পড়া দেয়াল, ফাটল ধরা স্তম্ভ, আগাছায় ঢাকা উঠোন, সবমিলিয়ে যেন ভুতুড়ে আবহে আবৃত। দিনের বেলায়ও গ্রামবাসীরা ভুলেও এর ধারে কাছে যায় না। কেবল রাত গভীর হলে সেখানে শুরু হয় অদ্ভুত এক কাণ্ড।
বহু বছর ধরেই গ্রামের মানুষ রাত হলেই বাড়িটার ভেতরে দেখেছে অস্বাভাবিক একটা আলো—নীলচে, কুয়াশাময়, কখনও জ্বলছে, কখনও নিভে যাচ্ছে। প্রথম দিকে গ্রামের মানুষ খুব একটা পাত্তা না দিলেও, দিন দিন আলোটার সাথে যুক্ত হতে থাকে বিচিত্র কিছু ঘটনা। কেউ কেউ রাতের আলো দেখে অসুস্থ হতে থাকে। আতঙ্ক বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। একসময় গ্রামের সবাই এটাকে অপয়া ভেবে বাড়িটির দিকে যাওয়াই বন্ধ করে দেয়।
কিন্তু কৌতূহলের আগুন কি সহজে নিভে যায়?
গ্রামের ভেতর এই নিয়ে আলোচনা হয় ফিসফিস করে, আড়ালে-আবডালে। বড়রা বারণ করে, ছোটরা লুকিয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকে। রহস্য বাড়তে বাড়তে একসময় ভয়টা রীতিমতো কুসংস্কারের রূপ নেয়। কেউ কেউ বলে, বড়ি সাহেবের অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায় বাড়িটার ভেতরে। আবার কেউ দাবি করে, বাড়িতে লুকিয়ে আছে কোন গুপ্তধন, যা রক্ষা করছে ভয়ংকর কোনো অলৌকিক শক্তি।
এভাবেই দিনের পর দিন গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে থাকে আতঙ্ক, রহস্য আর কুসংস্কার। গ্রামের নির্জনতায় যেন একটা চাপা অস্বস্তি বাসা বাঁধে।
বড়ি সাহেবের বাড়ি
ছায়াপুরের দিনগুলো বড় অলস আর শান্ত ছিল। গ্রামের মানুষ চাষবাস, ছোটখাটো ব্যবসা আর নিজেদের নিয়ে বেশ ছিল। কিন্তু এই নিরিবিলি জীবনেই হঠাৎ যেন ছন্দপতন ঘটলো, যখন একদিন গ্রামের সবচেয়ে রহস্যময় স্থান, বড়ি সাহেবের বাড়িতে দেখা গেল অস্বাভাবিক এক আলো।
শুরুতে আলোটা দেখতে পেয়েছিল গ্রামের দুই কিশোর—বাবলু আর রতন। একদিন সন্ধ্যার পর বাড়ির পেছনে আমগাছ থেকে আম চুরি করে ফেরার পথে, তারা হঠাৎ লক্ষ্য করল বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে মৃদু, নীলচে রঙের এক আলো। ঠিক যেন ধোঁয়ার মতো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ভয়ে-আতঙ্কে তারা দ্রুত বাড়ি ফিরে এলো, কিন্তু ব্যাপারটা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে।
পরদিন সকাল হতেই শোনা গেল এক অদ্ভুত খবর—গত রাতে আলো দেখার পর থেকেই বাবলু প্রচণ্ড জ্বরে বিছানা নিয়েছে। শরীর জ্বলছে, প্রলাপ বকছে, আর বিড়বিড় করে বারবার বলে যাচ্ছে, “ওরা আসছে, ওরা আসছে!”
গ্রামের মানুষ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না, কারা আসছে? কিসের কথা বলছে বাবলু?
সেদিন থেকেই গ্রামে আতঙ্কের সূচনা। গ্রামের প্রবীণ মানুষরা জানালেন, ওই বাড়িতে আগে কখনও এমন আলো দেখা যায়নি। বড়ি সাহেব তো মারা গেছেন সেই স্বাধীনতার আগেই, তাহলে কে জ্বালাতে পারে এমন আলো? গ্রামের মধ্যে শুরু হলো গুঞ্জন, সন্দেহ আর নানা অলৌকিক গল্প।
কয়েকদিন পরে একই ঘটনা ঘটলো গ্রামের বৃদ্ধ বিজনবাবুর বাড়িতে। মাঝরাতে জল আনতে উঠেই তিনি বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেই একই রহস্যময় আলো—নীলচে, রহস্যে মোড়া, যেন অন্য কোনো দুনিয়া থেকে এসে ছড়িয়ে যাচ্ছে গ্রামের আকাশে-বাতাসে। তিনি সাহস করে একটু এগিয়ে যেতেই দেখলেন আলোটা হঠাৎ করে নিভে গেল। তারপরেই সারা শরীরে শীতল একটা অনুভূতি নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। সারারাত জ্বরে কেঁপে উঠলেন, আর বিড়বিড় করে বললেন, “আমি কিছু দেখিনি, কিচ্ছু না…”
এখন আতঙ্কটা গ্রামের প্রতিটি ঘরের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। বড়ি সাহেবের বাড়ি যেন গ্রামের মানুষের জন্য হয়ে উঠল অভিশাপ। সন্ধ্যা নামার আগেই গ্রামের দরজাগুলো শক্ত করে বন্ধ হয়ে যেতে লাগল, জানালাগুলোতে ঝুলতে লাগল কালো কাপড়।
এদিকে গ্রামের প্রবীণ মানুষরা জানালেন, বিষয়টা পুলিশকে জানানোর দরকার নেই। তাদের মতে, পুলিশ কখনও রহস্য সমাধান করবে না, বরং পরিস্থিতি আরও খারাপ করে ফেলবে। গ্রামবাসীরা নিজেদের মধ্যেই আলোচনা শুরু করল—গ্রামে আসলে কী হচ্ছে? কেন ঘটছে এসব ঘটনা?
সময়ের সাথে সাথে আতঙ্ক বাড়ছিল, মানুষ আরও বেশি করে আবিষ্কার করতে লাগল নিজেদের অসহায়ত্বকে। রহস্যটা দিনে দিনে আরও জটিল হয়ে উঠতে থাকল। গ্রামের পুরনো লোকেরা বলতে লাগলেন, বড়ি সাহেবের অশান্ত আত্মা হয়তো ফিরে এসেছে। কেউ কেউ বলতে লাগল, ওই বাড়িতে লুকানো আছে কোনো গুপ্তধন, যা পাহারা দিচ্ছে অপশক্তি।
ছায়াপুর গ্রাম ডুবে গেল অজানা এক আতঙ্কে। কেউ জানতো না, সামনে কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।
পাপের আগুন
ছায়াপুর গ্রামের বাতাস ভারী হতে শুরু করল অদ্ভুত এক আতঙ্কে। সন্ধ্যার সূর্য পশ্চিমের গাছের আড়ালে একটু ঢলে পড়লেই, বাড়ির জানালা-দরজাগুলো দ্রুত বন্ধ হতে লাগল। গ্রামজুড়ে নেমে এল এক ধরনের অলিখিত কারফিউ। যেন সন্ধ্যার পরে ওই বাড়ির দিকে তাকানো, কিংবা বাড়ির বাইরে পা রাখাই অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বড়ি সাহেবের পরিত্যক্ত বাড়িতে নীলচে আলো দেখা যাওয়ার পর থেকেই গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল বিচিত্র সব গুজব। গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ নারী, নব্বই বছর বয়সী সবিত্রী ঠাকুমা তার কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “বড়ি সাহেবের আত্মা শান্তি পায়নি। কত খারাপ লোক ছিল সেই সাহেব! কত মানুষের ক্ষতি করেছে, হয়তো আজও তার পাপের আগুন জ্বলছে ওই বাড়িতে!”
তার কথায় ভয় আরও বেড়ে গেল গ্রামের মানুষদের মধ্যে। কেউ বলল, “বড়ি সাহেব হয়তো ফিরে এসে গ্রামবাসীদের প্রতিশোধ নিতে চাইছে।” কেউ আবার বলল, “হতে পারে, বাড়ির নিচে গুপ্তধন লুকানো আছে, সেই ধন পাহারা দিতে আসছে অপদেবতা।”
বাবলুর মা জড়োসড়ো হয়ে গ্রামে বলে বেড়ালেন, “আলোটা মানুষের প্রাণ টেনে নেয়! আমার ছেলেটার কী অবস্থা দেখছেন সবাই! কাল হয়তো অন্য কারো পালা।”
এর মধ্যে গ্রামের ডাক্তার অনির্বাণ চেষ্টা করেছিলেন মানুষকে শান্ত করতে, বলেছিলেন, “এটা হয়তো কোনো বৈজ্ঞানিক ঘটনা, কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া বা অন্য কিছু। ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই!”
কিন্তু গ্রামের লোকের কাছে তার কথার কোনো দাম নেই। আতঙ্কের ছায়ায় আবৃত হয়ে গ্রামের মানুষ দিন দিন আরও কুসংস্কারে ডুবে যেতে লাগল। দিনের আলোতেও গ্রামের রাস্তাঘাট যেন নিঝুম হয়ে রইল। কেউ আর বাড়ির বাইরের গাছের ছায়াতেও পা দিতে চায় না।
দিনের শেষে সবাই যেন অপেক্ষা করতে থাকে সন্ধ্যার জন্য। সন্ধ্যা হলেই আতঙ্ক নতুন করে গ্রামটাকে চেপে ধরে। প্রত্যেকের বাড়ির দেওয়ালে, চৌকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো পবিত্র কিছু চিহ্ন—তাবিজ, ঝাড়-ফুঁকের সামগ্রী, কেউ ঝুলিয়ে দিল তুলসীপাতার মালা। যেন এইসব জিনিস বাড়ির অশুভ শক্তিকে দূরে রাখবে।
সন্ধ্যার পর গ্রামের পুরো এলাকা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কুকুরগুলোও যেন ডাকতে ভুলে গেছে। শুধু দূর থেকে ভেসে আসে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। আর এই নীরবতার মধ্যেই যেন শোনা যায়—বড়ি সাহেবের বাড়ির দিক থেকে মৃদু, চাপা কিছু আওয়াজ। কেউ যেন নিঃশ্বাস ফেলছে, ফিসফিস করে কিছু বলছে।
ছায়াপুর গ্রাম ডুবে যায় গাঢ় অন্ধকারে।
গ্রামবাসীরা জানতো না, যে রহস্য তাদেরকে এভাবে বন্দি করে ফেলেছে, সেটার সত্যতা আদৌ কতটা গভীর—কতটা ভয়াবহ হতে পারে এর আসল কারণ।
নতুন মাস্টারমশাই
শহর থেকে ছায়াপুরের পথটা এতটা দীর্ঘ আর দুর্গম হবে, রাহুল তা ভাবেনি। রিকশা থেকে নামতেই ধুলোয় ঢাকা ছোট্ট বাসস্ট্যান্ডে তার চোখ গেল গ্রামটার দিকে—চারপাশটা নির্জন, সবুজে ঘেরা। কিন্তু কোথাও একটা চাপা অস্বস্তি যেন বাতাসে মিশে রয়েছে।
হাতে একটা মাঝারি ব্যাগ আর ছোট একটা স্যুটকেস নিয়ে সে এগিয়ে গেল সামনের দোকানটার দিকে। ছোট একটা চায়ের দোকান, সেখানে কয়েকজন বসে ছিল। কিন্তু রাহুলকে দেখেই যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল তাদের কথাবার্তা। দুজন ফিসফিস করে কী যেন বলতে লাগল।
“কাকা, ছায়াপুর প্রাইমারি স্কুলটা কোনদিকে বলতে পারবেন?”—রাহুল সরলভাবেই জিজ্ঞেস করল দোকানের বয়স্ক মালিককে।
লোকটা একটু বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আপনিই নতুন মাস্টারমশাই নাকি?”
“হ্যাঁ, আমি রাহুল। স্কুলে যোগ দিতে এসেছি,” সে হাসি মুখেই জবাব দিল।
চায়ের দোকানের পাশে বসা লোকগুলোর মধ্যে আবার শুরু হলো নিচু স্বরে ফিসফিসানি। মাঝেমাঝে চোরাচোখে তাকাচ্ছিল রাহুলের দিকে। তাদের চোখে কেমন যেন সন্দেহ, অবিশ্বাস আর অজানা ভয়ের ছাপ। যেন রাহুলের গ্রামে আসাটা একেবারেই অবাঞ্ছিত, অপ্রত্যাশিত।
রাহুল অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, গ্রামের পথ ধরে হাঁটার সময় প্রতিটা বাড়ির জানালা দিয়ে কেউ না কেউ উঁকি দিয়ে দেখছে তাকে। একজন বয়স্ক মহিলা দেখামাত্র জানালা বন্ধ করে দিলেন ঝট করে, যেন তিনি কোনো ভূত দেখেছেন। রাস্তার পাশে দাঁড়ানো কয়েকটা ছোট ছেলেমেয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপরই কেউ একজন বলল, “মনে হয় নতুন স্যার, বেচারা কি সব জানে?”
এই কথাগুলো শুনেই কেমন একটা অস্বস্তি চেপে বসল রাহুলের মনে। কিন্তু ঠিক কী কারণে গ্রামের মানুষ তার দিকে এমন সন্দেহ আর অবিশ্বাসের দৃষ্টি দিচ্ছে, তা কিছুতেই বুঝতে পারল না সে।
গ্রামের ছোট স্কুলঘরটাতে পৌঁছাতেই সেখানে দাঁড়ানো প্রহরীও তাকে দেখে চমকে উঠল। রাহুলকে দেখে সে মৃদু স্বরে বলল, “আপনার তো আজ আসার কথা ছিল না।”
“কেন, কোনো সমস্যা?” রাহুল একটু অবাক হয়েই জানতে চাইল।
প্রহরী কিছুটা দ্বিধা করে বলল, “সমস্যা নয়, মাস্টারমশাই। তবে গ্রামে আজকাল যা চলছে, আপনার শহর থেকে এখানে আসাটা যে ভালো হলো, তা বলব না।” কথাটা শেষ করেই প্রহরী দ্রুত সরে গেল।
রাহুল স্কুলের উঠোনে দাঁড়িয়ে চারপাশটা একবার ভালো করে দেখল। কোথায় যেন একটা রহস্যের গন্ধ লুকিয়ে আছে, গ্রামের প্রতিটি মানুষের চোখে-মুখে অজানা আতঙ্ক, যেন সবাই কিছু একটা গোপন করছে।
তার মনে হলো, গ্রামে আসার আগে তাকে কিছুই জানানো হয়নি। সে ভাবল, ছায়াপুরে এসে হয়তো তার নতুন জীবন শুরু হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এই গ্রাম তাকে স্বাগত জানাচ্ছে না, বরং তাকে আরও গভীর কোনো রহস্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ক্লাসঘর
ছায়াপুর প্রাইমারি স্কুলের ছোট্ট ক্লাসঘর। বাইরের জানালা দিয়ে সকালের রোদ এসে পড়েছে ছাত্রছাত্রীদের ডেস্কে। প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকতেই রাহুল খেয়াল করল, ছাত্রছাত্রীরা অস্বাভাবিকভাবে শান্ত ও গম্ভীর। শহরে সে এমন শান্ত পরিবেশের ক্লাস আগে কখনও দেখেনি।
রাহুল হাসিমুখে ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাদের গ্রামের নামটা কিন্তু বেশ সুন্দর—ছায়াপুর। তোমাদের গ্রামে কী কী আছে, একটু বলবে কেউ?”
ক্লাসটা সম্পূর্ণ নীরব হয়ে রইল। যেন প্রশ্নটা তাদের কাছে খুব অস্বস্তিকর, বা এই নিয়ে কিছু বলতে তারা ভয় পাচ্ছে।
রাহুল আবারও চেষ্টা করল, “কী ব্যাপার? কেউ কিছু বলছ না কেন? আচ্ছা, তোমাদের গ্রামে একটা পুরনো বাড়ি আছে না— বড়ি সাহেবের বাড়ি, সেটা দেখেছো কেউ?”
এবার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চাপা একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল। কেউ মাথা নিচু করে ফেলল, কেউ আবার পাশের বন্ধুকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাল যেন এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বড় অপরাধ।
ক্লাসের শেষের সারিতে বসা একটি মেয়ে হঠাৎ দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলে ফেলল, “স্যার, গ্রামে কিছু ব্যাপার ঘটে, যেগুলো নিয়ে কথা না বলাই ভালো।”
কথাটা বলে সে নিজের মুখ চট করে নিচু করে ফেলল। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রাহুল জানতে চাইল, “তোমার নাম কী?”
“মিলি, স্যার,” নিচু স্বরে উত্তর দিল সে।
“মিলি, কীসের কথা বলছো তুমি? গ্রামে কী এমন ঘটনা ঘটে?” রাহুলের কণ্ঠে কৌতূহল স্পষ্ট হয়ে উঠল।
মিলি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে মাথা তুলে বলল, “স্যার, এখানে সবাই রাতে ঘর থেকে বেরোতে ভয় পায়। বড়রা বলে—গ্রামে কিছু একটা আছে, যেটা কাউকে দেখতে দেয় না, জানতে দেয় না।”
মিলির কথাগুলো শুনে ক্লাসের অন্যরা যেন আরও সঙ্কুচিত হয়ে গেল। কেউ কেউ মিলির দিকে তাকিয়ে এমনভাবে মাথা নাড়ল, যেন তাকে কথা না বলতে নিষেধ করছে।
রাহুল বিস্মিত ও আগ্রহী হয়ে গেল। এই গ্রামের মানুষ আর এই ছোট্ট মেয়েটাও কিসের ভয়ে এতটা আতঙ্কিত? কী লুকিয়ে আছে এই রহস্যের আড়ালে?
সে সিদ্ধান্ত নিল, মিলির সঙ্গে পরে আলাদা কথা বলতে হবে। হয়তো মিলির কাছ থেকেই সে জানতে পারবে গ্রামের সেই গোপন সত্য, যা সবাই এড়িয়ে যাচ্ছে।
ক্লাস শেষ হওয়ার ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে ছাত্রছাত্রীরা প্রায় ছুটেই বেরিয়ে গেল। রাহুল জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, মিলি একবার ফিরে তাকিয়ে তার দিকে অর্থপূর্ণভাবে তাকিয়ে আছে। তার চোখে ছিল আশঙ্কা আর আশার এক অদ্ভুত মিশ্রণ।
রাহুল বুঝতে পারল, ছায়াপুরের এই রহস্য শুধু অদ্ভুত নয়, বরং আরও গভীর, আরও ভয়ংকর কিছু। তার মন বলল, এই গ্রাম আর তার মধ্যকার অজানা রহস্যগুলো তাকে এখন থেকেই চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করেছে।
সতর্কতা নাকি কোনো গোপন হুমকি
সন্ধ্যার পর, গ্রামের ছোট্ট বাজারে একটাই চায়ের দোকান খোলা ছিল। সেখানে টিমটিম করে জ্বলছিল একটা পুরোনো হারিকেন। দোকানটা প্রায় ফাঁকা—কেবল দোকানদার আর আরও একজন বৃদ্ধ বসে আছেন। রাহুল একটু এগিয়ে গিয়ে চায়ের অর্ডার দিল। দোকানদার তাকে দেখে হালকা মাথা নাড়লেন।
“নতুন মাস্টারমশাই বুঝি?” বৃদ্ধটি সরাসরি না তাকিয়েই প্রশ্ন করলেন।
“হ্যাঁ, আজই এলাম। আপনি…?” রাহুল বিনীত কণ্ঠে জানতে চাইল।
“বিজন, বিজন রায়। এই গ্রামেই জন্ম, এই গ্রামেই বুড়ো হলাম,” বৃদ্ধ সংক্ষেপে বললেন।
রাহুল কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, “বিজনবাবু, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
বিজনবাবু হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে গেলেন, চোখের পলক পড়ল দ্রুত, যেন প্রস্তুত হচ্ছেন কোনো কঠিন প্রশ্নের জন্য। বললেন, “বলুন, কী জানতে চান?”
“গ্রামের শেষ প্রান্তে নাকি একটা পুরনো বাড়ি আছে? ওখানে কিছু একটা ঘটে—?”
বিজনবাবু আচমকাই মাঝপথে থামিয়ে দিলেন তাকে। দ্রুত মাথা নিচু করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “ওসব কিছু না, মাস্টারমশাই। গ্রামের মানুষ কথায় কথায় ভয় পায়, আপনি ওসবে কান দেবেন না।”
“কিন্তু আমি শুনলাম—সেখানে মাঝেমাঝেই রাতের বেলা আলো দেখা যায়?” রাহুল এবার সরাসরি প্রশ্ন করল।
বিজনবাবু কিছুক্ষণ নিরব থাকলেন। তারপর হঠাৎ করেই প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, “আপনার শহরটা কী যেন নাম বললেন?”
রাহুল অবাক হয়ে বলল, “আমি তো শহরের নাম বলিনি। কিন্তু—”
বিজনবাবু আবারও কথা কাটলেন, “শহরে মানুষ বেশি হলে সমস্যা বাড়ে। গ্রামে মানুষ কম, তবু এখানে সমস্যা আরও বেশি। জানেন কেন? কারণ এখানে কেউ কারও কথা শোনে না।”
রাহুল এবার বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। লোকটা যেন ইচ্ছে করেই কথা ঘুরিয়ে তাকে বিভ্রান্ত করছে। রাহুল আবার মূল প্রসঙ্গে ফিরতে চেষ্টা করল, “বিজনবাবু, ওই বাড়িটায় আসলে কী ঘটে?”
বিজনবাবু এবার দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দোকানদারের দিকে অর্থপূর্ণ চোখে তাকিয়ে বললেন, “আমার বাকির খাতায় লিখে রেখো, পরে দিয়ে দেব।”
এরপর দোকান থেকে বেরোতে বেরোতে তিনি রাহুলের পাশে এসে থেমে, গলার স্বর নামিয়ে অস্বাভাবিক কণ্ঠে বলে গেলেন,
“বেশি কৌতূহল ভালো নয়, মাস্টারমশাই। গ্রামে কেউ কারও বন্ধু না।”
কথাটা শুনে রাহুলের শরীর কেমন যেন শিউরে উঠল। বিজনবাবু অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন, কিন্তু রাহুল দাঁড়িয়ে থাকল দোকানের সামনে, চিন্তার ভেতরে ডুবে। বিজনবাবুর কথাগুলো কোনো সতর্কতা নাকি কোনো গোপন হুমকি, তা তার কাছে স্পষ্ট হলো না। বরং এই রহস্যের জটিলতা যেন আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরল তাকে।
জটিল রহস্য
রাত তখন গভীর। গ্রামের চারদিকে যেন নিঃশ্বাস ফেলাটাও নিষিদ্ধ। রাহুল অনেক চেষ্টার পরেও ঘুমাতে পারছিল না। ছায়াপুরের অদ্ভুত পরিবেশ, গ্রামবাসীদের রহস্যজনক আচরণ আর বিজনবাবুর সতর্কবাণী—সব মিলিয়ে তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল নানা অস্বস্তিকর ভাবনা।
হঠাৎ জানালার বাইরে থেকে মৃদু একটা শব্দ ভেসে এলো। প্রথমে পাত্তা দিল না সে, কিন্তু আবারো শুনতে পেল কেউ যেন বাড়ির পাশ দিয়ে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে। রাহুল বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে গেল। বাইরে চাঁদের মৃদু আলোয় আবছা হয়ে দেখা যাচ্ছে একটা মানুষের অবয়ব—হাতে টর্চ লাইট, মুখটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছে।
কে সে? এত রাতে এখানে কী করছে?
রাহুল দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে অনুসরণ করতে শুরু করল লোকটাকে। দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে ছায়ার মতো সে এগিয়ে চলল গ্রামের শেষ প্রান্তে বড়ি সাহেবের বাড়ির দিকে। লোকটার হাতের টর্চের আলোটা মুহূর্তের জন্য থেমে গেল—তারপরই হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা। যেন চোখের পলকে মিলিয়ে গেল অন্ধকারের ভেতরে।
“এটা কীভাবে সম্ভব?” অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল রাহুল। চারপাশে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না—শুধু রহস্যময় নীরবতা আর অন্ধকার। তার মনে হলো, যেন পুরো গ্রামটাই গভীর এক রহস্যের আবরণে ঢাকা।
পরদিন সকালে ক্লান্ত শরীরে স্কুলে যাওয়ার পথে গ্রামের বাজারে পরিচয় হলো গ্রামের একমাত্র ডাক্তার অনির্বাণের সাথে। ডাক্তার অনির্বাণ অত্যন্ত মার্জিত ও নম্র স্বভাবের মানুষ। তিনি হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললেন, “আপনিই নতুন শিক্ষক তো? আমি অনির্বাণ চ্যাটার্জি।”
রাহুলও বিনীত হাসি দিয়ে বলল, “জ্বী হ্যাঁ। আমি রাহুল।”
কথার মাঝে ডাক্তারের ব্যক্তিত্বে একটা অদ্ভুত আভিজাত্য ছিল। গ্রামের মানুষজন তাঁকে প্রচণ্ড সম্মান করেন, তা সহজেই বোঝা যাচ্ছিল। রাহুল কিছুটা দ্বিধা করে গত রাতের ঘটনাটা তাকে জানাল।
অনির্বাণ মনোযোগ দিয়ে সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর গভীর চোখে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন, “দেখুন রাহুলবাবু, ছায়াপুর গ্রামটা বাইরে থেকে দেখতে যতটা নিরিবিলি আর শান্ত, ভেতরে কিন্তু ততটাই জটিল। গ্রামের কিছু জিনিস আপনি না জানলেই ভালো।”
কথাটা এত হঠাৎ আর অদ্ভুতভাবে বললেন তিনি যে রাহুলের মনে আরও বেশি সন্দেহের জন্ম দিল। সে ভাবল, ডাক্তার অনির্বাণের মতো মার্জিত মানুষও কি তাহলে কিছু গোপন করছেন? কেনই বা সবাই বারবার তাকে এই গ্রামের রহস্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে?
রাহুলের মনে আরও স্পষ্ট হলো একটা কথা—
ছায়াপুরের অন্ধকার রহস্য তার ভাবনার চেয়েও গভীরে বিস্তৃত, আর সেই রহস্যের জালে সে নিজেই আটকে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
বাদামি নোটবুক
পরদিন সকালে স্কুলে পৌঁছে রাহুল দেখল, ক্লাসঘরে তখনও কেউ আসেনি। ঘরটা ফাঁকা ও নিস্তব্ধ, শুধু জানালা দিয়ে আসা রোদের রেখাগুলো ডেস্কের ওপর খেলা করছে। নিজের টেবিলের কাছে এসে বসতে গিয়ে সে থমকে দাঁড়াল। তার ডেস্কের ওপর রাখা আছে একটি ছোট, পুরনো, বাদামি রঙের নোটবুক।
রাহুল কিছুটা বিস্মিত হয়ে নোটবুকটা হাতে নিল। পাতাগুলো হলদেটে, জীর্ণ—স্পষ্টতই বহু পুরনো। নোটবুকের ভেতরটা খুলতেই দেখল কয়েকটা পৃষ্ঠা ছেঁড়া, আর কিছু পৃষ্ঠায় লেখা আছে ছোট ছোট কবিতা। হাতের লেখাটা অপরিচিত, সুন্দর, স্পষ্ট—যেন কেউ গভীর যত্ন নিয়ে লিখেছে।
পাতাগুলো দ্রুত উল্টাতে উল্টাতে একটা বিশেষ কবিতায় এসে তার চোখ আটকে গেল। কবিতাটা অন্যগুলোর থেকে আলাদা, কেমন যেন রহস্যময় আর সাংকেতিক ভাষায় লেখা—
“আঁধার রাতে আসে আলো,
মুখোশধারীর খুঁজো ছায়া।
নব চাঁদের ফাঁদে পড়ে,
কাঁদছে গোপন এক মায়া।”
রাহুল বেশ কয়েকবার কবিতাটা পড়ল। শব্দগুলো সরাসরি কোনো অর্থ দিচ্ছে না, কিন্তু কিছু একটা লুকানো আছে এখানে। বিশেষ করে “মুখোশধারীর খুঁজো ছায়া” আর “নব চাঁদের ফাঁদ” শব্দগুলো তাকে ভাবিয়ে তুলল। গত রাতে যে মুখঢাকা মানুষকে সে অনুসরণ করেছিল, কবিতাটা কি সেই রহস্যময় মানুষটার কথাই বলছে?
ঠিক এই সময় দরজার বাইরে থেকে কয়েকটা ছাত্রছাত্রী হইচই করতে করতে ক্লাসে ঢুকে পড়ল। রাহুল দেখল, মিলি সবার শেষে ঢুকছে, তার চোখে-মুখে কিছুটা উদ্বেগ আর লুকানো কৌতূহল। সে বুঝতে পারল, নোটবুকটা হয়তো মিলিই রেখে গেছে।
রাহুল ক্লাস শুরু হওয়ার আগে মিলিকে ইশারায় কাছে ডাকল। মিলি দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে কাছে এল।
“মিলি, এই নোটবুকটা তুমি রেখেছো আমার টেবিলে?” মৃদু গলায় জানতে চাইল রাহুল।
মিলি কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে অবশেষে মাথা নাড়ল। বলল, “স্যার, ওই কবিতাটা আমার ঠাকুরদার লেখা। ঠাকুরদা কবিতা লিখতেন, কিন্তু কয়েক বছর আগে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান।”
রাহুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কবিতাগুলো যে খুব অদ্ভুত! এর অর্থ তুমি জানো?”
মিলি মাথা নেড়ে বলল, “না স্যার। কিন্তু ঠাকুরদা প্রায়ই বলতেন, ছায়াপুর গ্রামের অনেক অন্ধকার কোণে লুকিয়ে আছে সত্য। আর সত্যটা জানতে হলে প্রথমে ছায়ার পেছনের মুখোশটা খুঁজে বের করতে হবে।”
মিলির কথাগুলো শুনে রাহুলের মনে একটা ধারণা জন্ম নিল। সে বুঝতে পারল, নীলচে আলো আর রাতের মুখোশধারী লোকটা শুধু সাধারণ কোনো ঘটনা নয়— এর পেছনে লুকিয়ে আছে অনেক বড়, গভীর এক রহস্য।
কিন্তু এই রহস্যের জট খুলতে হলে তাকে আরও গভীরে যেতে হবে।
রাহুল এবার নিশ্চিত হয়ে গেল—সে আর ফিরে যেতে পারবে না। এই রহস্যের শেষ না দেখা পর্যন্ত তাকে এগোতেই হবে।
সুবোধবাবু?
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই রাহুল স্কুল থেকে বেরিয়ে গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগল—নোটবুকের কবিতাটা আর মিলির দেওয়া সূত্রগুলো ঘিরেই তার মনে এক বিশাল প্রশ্নের পাহাড় জমেছে। তার প্রথম সন্দেহ গিয়ে ঠেকল বিজনবাবুর দিকে। বিজনবাবুর সেই সতর্কবাণী, রহস্যময় আচরণ, আর অস্বাভাবিক কথাবার্তাই যেন তাকে সন্দেহের কেন্দ্রে ঠেলে দিয়েছিল।
কিন্তু ঠিক যখন সে ভাবছিল, হঠাৎ করেই তার চোখ পড়ল গ্রামের পুরনো লাইব্রেরির দিকে। ছোট্ট এই লাইব্রেরির দেখভাল করে সুবোধ নামে মধ্যবয়সী একজন ভদ্রলোক। চুপচাপ স্বভাবের, গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। গ্রামের মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধাও করে, আবার কিছুটা দূরত্বও বজায় রাখে।
রাহুল এক সন্ধ্যায় লাইব্রেরিতে গিয়ে সুবোধের সাথে আলাপ করতে গিয়ে দেখল, সুবোধ কী যেন একটা বই তাড়াহুড়ো করে বন্ধ করলেন। তার মুখে ছিল বিরক্তির স্পষ্ট ছাপ, যেন সে অনাহূত কারো আগমনকে পছন্দ করছে না।
“কিছু লাগবে?”— ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন সুবোধ।
“আমি একটু গ্রামের ইতিহাস নিয়ে জানতে চাইছিলাম,” সহজভাবে বলল রাহুল।
“এখানে বিশেষ কিছু ইতিহাস নেই,” সুবোধ খুব নির্লিপ্তভাবে বললেন, “শুধু গ্রামটায় কিছু পুরনো ভুতুড়ে গল্প আছে। এসব নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো।”
কথাটা বলে সুবোধ দ্রুত বইয়ের তাক গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রাহুল লক্ষ্য করল, সুবোধ কথাগুলো বলার সময় একবারও সরাসরি তার দিকে তাকাননি।
পরদিন সকালে রাহুল স্কুলে যাওয়ার পথে গ্রামের কয়েকজন যুবককে গল্প করতে দেখে এগিয়ে গেল। তাদের মধ্যে একজন বলল, “স্যার, গ্রামের বাইরে রাতে বেশি বেরোবেন না।”
রাহুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কেন? বিশেষ কোনো কারণ?”
অন্য আরেক যুবক একটু গলা নামিয়ে বলল, “স্যার, আজকাল সুবোধদা মাঝরাতে গ্রামের বাইরে যায়। তার হাতে টর্চ, মুখটা ঢাকা থাকে। কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কেউ জানে না।”
রাহুল শুনে কিছুটা বিস্মিত হলো। বলল, “সুবোধবাবু? উনি কেন?”
“সেটাই তো রহস্য, স্যার,” প্রথম যুবকটা বলল। “সুবোধদা আগে এমন ছিল না। কিছুদিন ধরে কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে। গ্রামের কেউ প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় না। বরং রেগে যায়।”
এই নতুন তথ্যটা রাহুলকে আরও বেশি বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিল। সে প্রথমে বিজনবাবুকে সন্দেহ করেছিল। এখন সুবোধের রহস্যময় আচরণে তার সন্দেহ আরও জটিল হলো। তাহলে কি সুবোধই সেই মুখোশধারী? নাকি আরও গভীর কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে গ্রামের ভিতরে?
রাহুল বুঝতে পারল, ছায়াপুর গ্রামের রহস্য যতটা সে ভেবেছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি গভীর, অনেক বেশি অন্ধকার। এখানে কাউকেই যেন পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না।
সন্দেহজনক আচরণ
রাহুল ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল, ছায়াপুর গ্রামের অন্ধকারের গভীরে লুকিয়ে আছে আরও বহু রহস্য। সুবোধের রহস্যজনক আচরণের পর থেকেই তার মনের সন্দেহটা এখন চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। কিন্তু পরবর্তী কয়েকদিনের ঘটনা তাকে বুঝিয়ে দিল, এখানে আসলে অনেকেই সন্দেহের বাইরে নয়।
একদিন বিকেলে ক্লাস শেষে স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই হেডমাস্টার মৃণালবাবুর ফোনে কথা বলার আওয়াজ পেল রাহুল। তিনি বারান্দার এক কোনায় দাঁড়িয়ে নিচু গলায় কথা বলছিলেন, কথাগুলো ছিল বেশ সন্দেহজনক।
“না না, এখানে কেউ কিছু জানেনি এখনও। … না, চিন্তার কিছু নেই, আমি সব সামলে নেব,”—এরপর আবার নীরবতা। হঠাৎ তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলেন, “আমি বলছি না, এসব ফোনে বলো না। শহরে এসে আমার সঙ্গে দেখা করো।”
কথাগুলো শুনে রাহুলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। হেডমাস্টার মৃণালবাবু দেখতে সহজ-সরল, শান্ত স্বভাবের মানুষ। কিন্তু তার কথাগুলো এমনই রহস্যজনক ছিল যে রাহুল না চাইলেও সন্দেহটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
ঠিক এর কয়েকদিন পরই বাজারে চায়ের দোকানে বসে গ্রামের কিছু মানুষের গোপন আলাপের সময় রাহুল আরও একটি বিস্ময়কর তথ্য শুনতে পেল। গ্রামের প্রভাবশালী নেতা নিবারণ বাবু, যাকে গ্রামের সবাই সমীহ ও ভয় করে চলে, তিনিও নাকি রাতের আঁধারে বড়ি সাহেবের বাড়ির আশেপাশে ঘুরতে দেখা গিয়েছে।
“আপনারা নিশ্চিত, উনিই ছিলেন?”—কিছুটা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল রাহুল।
একজন বয়স্ক গ্রামবাসী নিচু গলায় বললেন, “মাস্টারমশাই, এই গ্রামে কেউ কিছু মুখ ফুটে বলে না। কিন্তু নিজের চোখে দেখা জিনিস ভুল হয় না। আমি নিজে দেখেছি নিবারণবাবুকে গভীর রাতে বাড়িটার পাশে ঘুরতে।”
আরেকজন যোগ করলেন, “উনি খুব প্রভাবশালী লোক। উনার বিরুদ্ধে কিছু বলা সহজ নয়। কিন্তু উনার এসব রহস্যময় আচরণ গ্রামের সবাই জানে।”
রাহুলের সন্দেহের জাল আরও ঘনীভূত হলো। প্রথমে বিজনবাবু, তারপর সুবোধ, এবার হেডমাস্টার মৃণালবাবু এবং গ্রামের নেতা নিবারণ বাবুও। প্রত্যেকের আচরণই সন্দেহজনক, প্রত্যেকেই যেন কোনো না কোনো রহস্য আড়াল করতে ব্যস্ত।
সে বুঝতে পারল, গ্রামটা আসলে নিছক একটা নিরিবিলি শান্ত জায়গা নয়। বরং একটা গভীর ও গোপন ষড়যন্ত্রের জালে আবদ্ধ এক গ্রাম, যেখানে সত্যিটা বের করা খুব একটা সহজ কাজ হবে না। তার মনের ভেতরে আরও দৃঢ় হলো সংকল্প—এই রহস্য তাকে সমাধান করতেই হবে, যেকোনো মূল্যে।
LUX IN TENEBRIS
গ্রামের পরিবেশে প্রতিটা দিন কাটানোর সঙ্গে সঙ্গে রাহুলের কৌতূহল আর সংশয়— দুটোই বেড়ে চলেছিল। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিল, গ্রামের পুরনো লাইব্রেরিতে নিজে গিয়ে অনুসন্ধান করবে, যদি সেখানে লুকিয়ে থাকা কোনো সূত্র মেলে।
এক বিকেলে লাইব্রেরিতে গিয়ে বইয়ের তাকে রাখা পুরনো, ধুলোয় ঢাকা কয়েকটা বই নাড়াচাড়া করছিল রাহুল। হঠাৎই একটা পুরনো, জীর্ণ বইয়ের পাতা উল্টাতে গিয়ে সে থমকে দাঁড়াল। বইটার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল আধপোড়া একটা ম্যাপ।
কৌতূহলী হয়ে সে ম্যাপটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল। ম্যাপটা ছায়াপুর গ্রামেরই—কিন্তু সাধারণ কোনো ম্যাপ নয়। গ্রামের শেষ প্রান্তে থাকা সেই পুরনো বাড়িটা এই ম্যাপে স্পষ্ট করে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাড়িটার ঠিক পাশেই ছোট একটা টিলাও চিহ্নিত করা হয়েছে রহস্যজনক চিহ্ন দিয়ে। আর ম্যাপের একেবারে নিচে ছোট কিন্তু স্পষ্ট অক্ষরে লেখা একটা ল্যাটিন শব্দ:
“LUX IN TENEBRIS”
(অর্থ: অন্ধকারে আলো)
ল্যাটিন শব্দ দেখে রাহুলের চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। এই শব্দের সাথে মিলির দেওয়া কবিতার স্পষ্ট সংযোগ রয়েছে—
“আঁধার রাতে আসে আলো…”
রাহুল বুঝতে পারল, এই ম্যাপটা কোনো সাধারণ জিনিস নয়। গ্রামের এই অদ্ভুত ঘটনার সাথে এর গভীর একটা সম্পর্ক আছে। “অন্ধকারে আলো” কথাটার অর্থ কি গ্রামের সেই রহস্যময় নীলাভ আলোর দিকে ইঙ্গিত করছে?
তবে এই ম্যাপ কে এখানে রেখে গেছে? কেনই বা অর্ধেক পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এটা? যেন কেউ ইচ্ছে করেই প্রমাণগুলো নষ্ট করতে চেয়েছে। আবার এমনও হতে পারে, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবেই এটা রেখে গেছে—কিন্তু কেন?
রাহুলের মনের ভেতর হাজারটা প্রশ্নের জন্ম নিল।
একটা বিষয় সে বুঝতে পারল স্পষ্টভাবে—গ্রামের এই আলো, পুরনো বাড়ি, টিলা এবং রহস্যময় মুখোশধারী মানুষটার মধ্যে রয়েছে এক অবিচ্ছেদ্য, গভীর সংযোগ।
ম্যাপটা যত্ন করে নিজের পকেটে ভরে রাহুল দ্রুত লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এল। সন্ধ্যার অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকা গ্রামটা আজ তার কাছে অন্য রকম মনে হচ্ছে।
মনে হলো, রহস্যের আসল চাবিটা অবশেষে তার হাতে এসে পড়েছে। কিন্তু সেই সত্যিটা জানতে হলে তাকে যেতে হবে আরও গভীরে, আরও অন্ধকারে।
আর সেখানে তাকে কীসের মুখোমুখি হতে হবে—এখনও সেটা সে জানে না।
প্রথম তদন্ত
রহস্যময় ম্যাপটা পাওয়ার পর থেকেই রাহুলের ভেতরে অস্থিরতা যেন আরও বেড়ে গেল। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল, তাকে সেই বাড়ির কাছে গিয়ে সরাসরি দেখতে হবে—আসল ঘটনাটা কী। মিলিকেও সে নিজের পরিকল্পনার কথা বলল। মিলি প্রথমে একটু ভয় পেলেও পরে সাহস নিয়ে বলল, “স্যার, আমি যাবো আপনার সঙ্গে। ঠাকুরদার রেখে যাওয়া কবিতাগুলোর অর্থ জানতেই হবে আমাদের।”
সেদিন ছিল নতুন চাঁদের রাত। আকাশে তারা মিটমিট করলেও চারদিকটা ছিল গাঢ় অন্ধকারে ঘেরা। রাহুল আর মিলি চুপিচুপি গ্রামের শেষ প্রান্তের পথ ধরে এগিয়ে চলল বড়ি সাহেবের পরিত্যক্ত বাড়ির দিকে। গ্রামের সবাই ততক্ষণে গভীর ঘুমে অচেতন।
বাড়িটার কাছাকাছি আসতেই রাহুল মিলিকে থামার ইঙ্গিত দিল। দুজনে বড় একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে বাড়িটার দিকে তাকাল। চারপাশ নিঃস্তব্ধ, শুধু মাঝে মাঝে দূরে কোথাও রাতের পাখির ডাক।
হঠাৎই বাড়ির ভেতর থেকে অদ্ভুত একটা আলো বেরিয়ে এল—সেই আলো, নীলচে আর হালকা কুয়াশার মতো।
রাহুল ফিসফিস করে বলল, “মিলি, দেখো আলোটা!”
মিলি চোখ বড় করে তাকিয়ে ফিসফিস করল, “স্যার, এটা তো সাধারণ আলো নয়! দেখুন, মনে হচ্ছে কেউ ভেতরে কিছু করছে।”
রাহুল ভালোভাবে তাকিয়ে দেখল—আলোটা যেন স্থির নয়, ক্রমাগত নড়ছে। আলো-আঁধারিতে দেখা যাচ্ছে, বাড়ির ভেতর একটা মানুষ যেন কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত। মাঝেমাঝেই তার হাত ওঠানামা করছে। কখনো কিছুর ছায়া স্পষ্টভাবে দেওয়ালে পড়ছে।
“কে হতে পারে?” বিস্ময়ে প্রশ্ন করল মিলি।
“জানি না, কিন্তু ব্যাপারটা দেখতে হবে,” বলেই রাহুল আরও একটু সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই বাড়ির ভেতর থেকে একটা চাপা শব্দ হলো—যেন ভারী কিছু মাটিতে পড়েছে। মুহূর্তেই আলোটা নিভে গেল।
চারদিকে আবার ঘন অন্ধকার।
“স্যার, পালিয়েছে!” উত্তেজিতভাবে বলল মিলি।
রাহুল একটু হতাশ হলো, তবে তার কণ্ঠে ছিল আত্মবিশ্বাস—
“পালালেও আজ আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পেয়ে গেলাম, মিলি। এটা প্রমাণিত হলো, এই বাড়িতে রাতের বেলা কেউ না কেউ গোপনে কিছু করছে। গ্রামের মানুষ যা দেখেছে তা কল্পনা নয়, সত্যিই কিছু ঘটছে এখানে।”
মিলি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বলল, “তাহলে পরেরবার?”
“পরেরবার আমরা আরও সাবধান হব,” রাহুল দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, “এবারের তদন্তের শেষ না দেখা পর্যন্ত থামছি না।”
ফেরার পথে দুজনেই বুঝতে পারল, রহস্যটা এখন আরও গভীর হয়ে উঠেছে। বাড়ির ভেতরে কে কাজ করছিল, কেনই বা করছিল, তা জানার জন্য তাদের যেতে হবে আরও গভীরে, আরও বিপদের মুখে।
রহস্যের চাবিকাঠি
পরদিন খুব ভোরে আবার বড়ি সাহেবের বাড়ির দিকে গেল রাহুল আর মিলি। রাতের রহস্যময় ঘটনার পর ওরা দুজনেই নিশ্চিত, দিনের আলোতেই আরও কিছু সূত্র পাওয়া যেতে পারে। চারপাশে তখনও সূর্যের আলো পুরোপুরি ছড়ায়নি। কুয়াশায় ঢাকা পথ ধরে সাবধানে এগোতে থাকল ওরা।
বাড়িটার উঠোনে পৌঁছাতেই মিলি আচমকা থেমে গেল। কিছু একটা লক্ষ্য করে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, দেখুন!”
মাটিতে স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে কিছু অদ্ভুত পদচিহ্ন—সাধারণ জুতোর ছাপ নয়, বরং ভারী, বেশ বড় আকারের বুটের ছাপ। বেশ কিছুটা পথ ঘুরে বাড়ির পিছনের দিকে চলে গেছে এই পদচিহ্নগুলো।
“গতকাল রাতের সেই লোকটার পায়ের ছাপ হতে পারে,” বলে উঠল রাহুল। সে খুব মনোযোগ দিয়ে ছাপগুলো দেখতে লাগল। তারপর হঠাৎই লক্ষ্য করল, ছাপগুলো একটা নির্দিষ্ট দিকে চলে গেছে—বাড়ির ভেতরে।
“ভেতরে যাই, স্যার?” ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞেস করল মিলি।
রাহুল কিছুটা চিন্তা করেই বলল, “এসো। এখন ভেতরে না গেলে রহস্যটা থেকে যাবে।”
বাড়ির দরজাটা অর্ধেক খোলা ছিল। সাবধানে ওরা দুজনেই ভেতরে ঢুকল। চারদিকে ধুলো জমে আছে, মাকড়সার জালে ঢাকা দেয়াল। একটা ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা পুরো বাড়িটাকে গ্রাস করে আছে। কিন্তু ঘরের এক পাশে রাহুলের চোখ গেল একটা পুরনো কাঠের টেবিলের দিকে।
টেবিলের ওপর রাখা আছে কয়েকটা পুরনো ফাইল, তার পাশেই কিছু ছোট ছোট ঔষধের শিশি। রাহুল দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ফাইলগুলো খুলে দেখতে শুরু করল। ফাইলগুলো বহু পুরনো, কিছু পাতা হলুদ হয়ে গেছে, কিছু আবার আধপোড়া। কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এগুলো কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক রিপোর্ট। কিছু রাসায়নিকের নাম লেখা, কিছু সূত্র, আর তাদের পাশেই বিভিন্ন মানুষের নামের তালিকা—যেন কিছু একটা পরীক্ষা করা হচ্ছিল এখানে।
“স্যার, এই ঔষধের শিশিগুলো এখানে কেন?” মিলি কৌতূহলে জিজ্ঞেস করল।
রাহুল একটা শিশি তুলে ভালোভাবে দেখল। শিশিগুলোর গায়ে স্পষ্ট লেবেল নেই, শুধু কিছু সাংকেতিক চিহ্ন রয়েছে। এটা দেখে সে বেশ চিন্তিত হয়ে বলল, “মিলি, আমার মনে হয় এখানে কেউ গোপনে কিছু পরীক্ষা করছে। হয়তো এসব রাসায়নিক থেকেই সেই রহস্যময় আলোটা তৈরি হচ্ছে।”
“কিন্তু কে এমন করতে পারে?” মিলির কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।
রাহুল নিশ্চুপ হয়ে থাকল। ফাইল আর শিশিগুলোকে আরও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেই সে বুঝতে পারল, গ্রামের মানুষের অসুস্থতার সাথে এই রাসায়নিকগুলোর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই রহস্যের গহীন অন্ধকারের ভেতর থেকে সে এবার যেন এক চাবিকাঠি হাতে পেয়েছে।
কিন্তু এখনও একটা বড় প্রশ্ন থেকে গেল—কে করছে এই কাজ? এবং কেন?
রাহুল ও মিলি বুঝতে পারল, রহস্যের কেন্দ্রবিন্দুতে তারা পৌঁছেছে, কিন্তু আরও অনেক কঠিন পথ বাকি। এবার এই সত্যকে সামনে আনতেই হবে, গ্রামবাসীদের জন্য, এবং নিজেদের জন্যও।
রহস্যের জালে জড়িত
সেদিনের আবিষ্কারের পর থেকে বড়ি সাহেবের বাড়িটার ওপর নজর রাখতে শুরু করল রাহুল ও মিলি। দুজনেই নিশ্চিত, খুব শিগগিরই এই রহস্যের পেছনের মানুষটা ধরা পড়বে। কিন্তু সেদিন রাতেই এমন কিছু ঘটল, যা দুজনের ধারণাকেই পুরোপুরি বদলে দিল।
মাঝরাতে অন্ধকারে ঢাকা বাড়িটার কাছের জঙ্গলে লুকিয়ে বসেছিল রাহুল ও মিলি। চারদিকে গভীর নীরবতা, শুধু পাতা নড়ার হালকা আওয়াজ। হঠাৎই হালকা শব্দ পেয়ে রাহুল হাত তুলে মিলিকে ইশারা দিল চুপ করতে।
একটা ছায়া নিঃশব্দে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। লোকটার হাতে টর্চ নেই, কিন্তু তার হাঁটার ধরন কিছুটা অস্বাভাবিক। রাহুল উত্তেজিত হয়ে ফিসফিস করল, “মিলি, দেখো—ওটা কে!”
মিলি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। লোকটা বাড়িটার সামনে এসে থামল, তারপর আশপাশে ভালো করে দেখে নিয়ে ভেতরে ঢুকল।
“চলো, আমাদের দেখতে হবে,” বলে রাহুল সাবধানে উঠে দাঁড়াল। দুজন নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে ভাঙা জানালার একটা ফাঁক দিয়ে ভেতরের দিকে তাকাল। বাড়ির ভেতরে আবছা অন্ধকারে দেখা গেল, সেই রহস্যময় মানুষটা আর কেউ নয়—গ্রামের সেই প্রবীণ বিজনবাবু!
বিজনবাবু দ্রুত পায়ে ঘরের এক কোনায় গিয়ে কিছু একটা মাটির নিচে লুকিয়ে ফেললেন। তারপর চারপাশে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
“স্যার, বিজনদাদু এখানে কী লুকালেন?” ফিসফিস করে বলল মিলি।
“চলো, দেখে আসি,” বলে রাহুল বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। দুজনে এসে দাঁড়াল সেই কোণাটায়, যেখানে বিজনবাবু কিছু একটা লুকিয়েছেন। মাটি তখনও আলগা।
রাহুল সাবধানে মাটি সরিয়ে দেখল, ছোট্ট একটা লোহার বাক্স। বাক্সটা খুলতেই ভেতরে পাওয়া গেল কিছু পুরনো ছবি, একটা চিঠি, আর আরও কয়েকটা ঔষধের শিশি।
চিঠিটা খুলে পড়তে গিয়ে রাহুল থমকে গেল। তাতে লেখা ছিল,
“এই কাজ বন্ধ করুন বিজনদা। না হলে গ্রামের মানুষ কেউ বাঁচবে না। আপনার নিজের ভুলগুলো ঢাকতে গিয়ে পুরো গ্রামকে শেষ করবেন না।”
চিঠিটা পড়ে রাহুলের হাত কেঁপে উঠল। মিলি ভয়ার্ত চোখে বলল, “বিজনদাদু তাহলে সত্যিই কিছু লুকাচ্ছেন!”
“হ্যাঁ, কিন্তু কী সেটা?” গভীর চিন্তিত স্বরে বলল রাহুল। “আমাদের জানতে হবে।”
দুজনেই বুঝতে পারল, এই রহস্যের জালে বিজনবাবুও জড়িয়ে আছেন, কিন্তু আসল অপরাধী তিনিই কিনা তা এখনও পরিষ্কার নয়। এই মুহূর্তে শুধু একটা জিনিস স্পষ্ট—গ্রামের অনেকেই এই রহস্যের সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত।
লুকানো রহস্যের সন্ধান
পরদিন স্কুল ছুটি হওয়ার পরেই রাহুল আর মিলি আবারও একত্র হলো। আগের রাতে বিজনবাবুর লুকানো বাক্স থেকে পাওয়া পুরনো ফাইল আর চিঠিটা ওরা দুজনে মিলেই দেখতে শুরু করল। রাহুল ফাইলের পাতাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তে পড়তে হঠাৎই চমকে উঠল।
“মিলি, এগুলো দেখো! এই ফাইলে লেখা আছে—বহু বছর আগে এই বাড়িতে গোপনে কিছু নিষিদ্ধ ওষুধ বানানো হতো।”—রাহুল উত্তেজিতভাবে বলে উঠল।
“নিষিদ্ধ ওষুধ?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করল মিলি।
“হ্যাঁ, এগুলো এমন কিছু রাসায়নিক যা সাধারণ মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই রাসায়নিকগুলো থেকে এক ধরনের আলো তৈরি হতো, যা দেখতে অস্বাভাবিক নীলচে, কুয়াশার মতো,” রাহুল গম্ভীর হয়ে ব্যাখ্যা করল।
মিলি এবার আরও চিন্তিত হয়ে বলল, “তার মানে, গ্রামের অসুস্থতার কারণ এই নিষিদ্ধ রাসায়নিক?”
“হ্যাঁ, মনে হচ্ছে তাই। হয়তো রাসায়নিকগুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে, আর যারা সেই রাতে আলো দেখেছে তারা বিষাক্ত রাসায়নিকের সংস্পর্শে এসেছে,” গভীর চিন্তায় ডুবে গেল রাহুল।
ফাইলের ভেতরে থাকা আরও একটি নথিতে চোখ পড়তেই রাহুলের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। সেখানে স্পষ্ট করে লেখা ছিল—
“পরীক্ষার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ছায়াপুর গ্রাম। গ্রামের লোকজনের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এই নিষিদ্ধ ওষুধ তৈরি ও পরীক্ষা করতে হবে। বাইরের কেউ যেন জানতে না পারে।”
“স্যার, এটা তো আরও ভয়ানক!”— আতঙ্কিত গলায় বলল মিলি।
“কিন্তু কে করছে এই কাজ? বিজনবাবু, সুবোধ, নাকি অন্য কেউ?” রাহুলের কণ্ঠে উদ্বেগ স্পষ্ট হলো।
মিলি নীরবে মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের শিগগিরই জানতে হবে স্যার। গ্রামের মানুষদের রক্ষা করতে হবে।”
“হ্যাঁ, মিলি। এবার আমাদের পেছনে তাকানোর সময় নেই। গ্রামের আসল শত্রুকে এবার বের করতেই হবে,” দৃঢ় কণ্ঠে বলল রাহুল।
পুরনো বাড়ির অন্ধকার, রহস্যময় আলো আর গ্রামের মানুষের অসুস্থতার কারণ এখন পরিষ্কার। কিন্তু কে এই নিষ্ঠুর কাজের পেছনে রয়েছে—তা এখনও একটা গভীর ধাঁধা। রাহুল আর মিলি বুঝতে পারল, চূড়ান্ত সত্যের মুখোমুখি হতে হলে তাদের আরও গভীরে যেতে হবে। সেই সত্য সামনে আনার আগে, তারা জানতেও পারছে না কত বড় বিপদ ওঁত পেতে আছে।
বিজনবাবুর স্বীকারোক্তি
ফাইল আর চিঠির সূত্র ধরে পরদিন সন্ধ্যাতেই রাহুল বিজনবাবুর বাড়িতে গেল। বিজনবাবু তখন বাড়ির উঠোনে নিঃশব্দে বসেছিলেন, তাঁর মুখ ছিল মলিন ও চিন্তিত। রাহুলকে দেখেই তিনি যেন সবকিছু আঁচ করতে পারলেন। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “এসো মাস্টারমশাই। আমি জানতাম, একদিন তুমি ঠিকই চলে আসবে।”
“বিজনবাবু, গ্রামে কী চলছে, সেটা আমার জানা দরকার। সত্যিটা না জানলে গ্রামের মানুষকে বাঁচানো যাবে না,” রাহুল শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল।
বিজনবাবু কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। তারপর আস্তে আস্তে মাথা নিচু করে বললেন, “অনেক বড় ভুল করেছি আমি, মাস্টারমশাই। কিছু লোকের সঙ্গে যোগ দিয়ে লোভের বশে গোপনে নিষিদ্ধ ওষুধ তৈরি করছিলাম আমরা। আমার বয়স হয়েছে, লাভের আশা ছিল, শেষ বয়সে কিছু টাকা আসবে হাতে। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল!”
রাহুল অবাক হয়ে বলল, “আপনি জানতেন না এই ওষুধ গ্রামবাসীদের জন্য কতটা ক্ষতিকর?”
“প্রথমে বুঝিনি,” বিজনবাবু কাঁপা গলায় স্বীকার করলেন। “আমাদের বলা হয়েছিল, ওষুধগুলো সাধারণ কিছু জ্বর বা সর্দি-কাশির ওষুধ। পরে যখন গ্রামের লোক অসুস্থ হতে শুরু করল, তখন বুঝতে পারলাম আসলে কী ভুল করেছি আমরা।”
“তাহলে পুলিশে খবর দিলেন না কেন?”—রাহুল জিজ্ঞেস করল।
বিজনবাবুর চোখে জল এসে গেল, বললেন, “ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, নিজেরা ঠিক করতে পারব, গ্রামবাসীদের বুঝতে দেব না। কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল।”
“আর আপনারা তাই গ্রামের মানুষের মনে ভূতের ভয় ঢুকিয়ে দিলেন, যাতে কেউ ওখানে যেতে সাহস না পায়?”—রাহুল সরাসরি প্রশ্ন করল।
“হ্যাঁ, এটা সত্য,” বিজনবাবু স্বীকার করলেন। “ভেবেছিলাম, মানুষ ভয় পেলে কেউ সত্যটা জানার চেষ্টা করবে না।”
রাহুল কঠোর স্বরে বলল, “কিন্তু এইভাবে গ্রামবাসীদের জীবন নিয়ে খেলা করা হয়েছে। গ্রামের নিরীহ মানুষগুলোকে দিনের পর দিন বিপদের মুখে ফেলে রাখা হয়েছে!”
বিজনবাবু অনুতপ্ত গলায় বললেন, “আমি জানি, খুব বড় ভুল করেছি। শাস্তি যা হয়, আমি নিতে প্রস্তুত। কিন্তু আমাকে ক্ষমা করো মাস্টারমশাই, আমি সত্যিই আর এটা চালাতে পারছিলাম না।”
রাহুল কিছুক্ষণ চুপ থেকে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আপনার স্বীকারোক্তি গ্রামবাসীদের জানানো প্রয়োজন। শুধু তবেই এই রহস্যের শেষ হবে।”
বিজনবাবু মাথা নিচু করেই বললেন, “আমি তৈরি আছি।”
রাহুল বুঝতে পারল, ছায়াপুর গ্রামের বহুদিনের রহস্য এবার সমাধানের শেষ পর্যায়ে। কিন্তু এখনও একটা বড় প্রশ্ন থেকে গেল—বিজনবাবুর পেছনে আসল পরিকল্পনাকারী কে? তিনি কী এখনও আড়ালে থেকে নতুন কোনো বিপদের ছক কষছেন?
গ্রামবাসীদের সত্য জানানো
পরদিন সকালে গ্রামের চায়ের দোকানের সামনে মাঠে রাহুল গ্রামের সকল মানুষকে জড়ো করল। খবরটা ছড়াতেই গ্রামের মানুষ আতঙ্ক আর কৌতূহল নিয়ে এসে উপস্থিত হলো। তাদের মুখে একই প্রশ্ন—এতদিনের রহস্য কি শেষ পর্যন্ত সামনে আসছে?
সবাই আসার পর বিজনবাবুকে নিয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এল রাহুল। মিলিও দাঁড়িয়েছিল পাশে। গ্রামের মানুষদের মুখে ছিল অস্থিরতা, সন্দেহ, এবং উৎকণ্ঠা। রাহুল পরিষ্কার গলায় বলল—
“আপনারা এতদিন ধরে যে অদ্ভুত আলো দেখছেন, যে কারণে এত আতঙ্কে দিন কাটিয়েছেন, তার সত্যটা আজ আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।”
সবাই আগ্রহ নিয়ে আরও কাছে এগিয়ে এল। রাহুল দৃঢ় কণ্ঠে বলতে লাগল, “এই রহস্যের পেছনে কোনো ভূত-প্রেত বা অশুভ আত্মা নেই। আসলে, বড়ি সাহেবের পরিত্যক্ত বাড়িটিতে কিছু অসাধু লোক গোপনে নিষিদ্ধ রাসায়নিক দিয়ে ওষুধ বানাত। এই ওষুধ মানুষের শরীরে মারাত্মক ক্ষতি করছিল, যার কারণেই গ্রামে এতজন মানুষ অসুস্থ হয়েছে।”
ভিড়ের ভেতর একটা চাপা গুঞ্জন উঠল। কেউ কেউ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকাল, কেউ আবার আতঙ্কে।
রাহুল হাত উঁচিয়ে সবাইকে শান্ত করে বলল, “বিজনবাবু এই ঘটনা সম্পর্কে সব জানতেন। তিনি নিজের দোষ স্বীকার করেছেন। বিজনবাবু, এবার আপনি নিজেই সবাইকে বলুন।”
বিজনবাবু মাথা নিচু করে কাঁপা গলায় গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “আমি লোভের বশবর্তী হয়ে, কিছু লোকের সাথে মিলে এই কাজ করেছি। পরে বুঝতে পারি আমার ভুল হয়েছে। আমি আপনাদের কাছে অপরাধী, আমাকে ক্ষমা করবেন।”
বিজনবাবুর স্বীকারোক্তিতে সবাই হতবাক হয়ে গেল। কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকার পর হঠাৎ গ্রামের একজন প্রবীণ কৃষক উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, “আপনারা গ্রামের মানুষের বিশ্বাস নিয়ে খেলা করেছেন! আমরা আপনাদের বিশ্বাস করেছিলাম!”
এরপর গ্রামের আরেকজন চিৎকার করে বললেন, “এসব লোককে গ্রামে রাখা যায় না! আমরা পুলিশ ডাকব, পুলিশকে জানাবো!”
গ্রামের মানুষ একসঙ্গে সায় দিল। তারা বুঝতে পেরেছে, তাদের এতদিনের কুসংস্কার আর ভয় ছিল ভিত্তিহীন, যার সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু মানুষ গ্রামের ক্ষতি করছিল।
রাহুল তখন বলল, “আপনারা একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দোষীদের শাস্তি না হলে গ্রামের শান্তি কখনো ফিরে আসবে না।”
গ্রামবাসীরা একযোগে সিদ্ধান্ত নিল—সবাই মিলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, আইনের হাতে তুলে দেবে। বিজনবাবু মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে থাকলেন, তাঁর চোখে অনুশোচনার অশ্রু।
ছায়াপুর গ্রামের দীর্ঘদিনের রহস্যের অন্ধকার আজ অবশেষে কেটে যেতে শুরু করল। তবে আসল পরিকল্পনাকারী, যিনি এখনও অন্ধকারে আছেন, তাঁর মুখোশ পুরোপুরি খুলে ফেলার কাজটা বাকি রয়ে গেল।
গ্রামবাসীদের একসঙ্গে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিনই পুলিশ এসে হাজির হলো। গ্রামের সেই রহস্যময় বড়ি সাহেবের বাড়িটা সম্পূর্ণ সিল করে দেওয়া হলো। পুলিশের উপস্থিতিতে সেই বাড়ি থেকে নিষিদ্ধ রাসায়নিক এবং ওষুধ তৈরির সব সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করা হলো। বিজনবাবুসহ এই অপরাধের সাথে জড়িত আরও কয়েকজনকে আটক করে নিয়ে গেল পুলিশ।
কিন্তু রাহুলের মনে একটা ছোট প্রশ্ন থেকে গেল—সেই আসল অপরাধী, যে অন্ধকার থেকে এই ষড়যন্ত্র চালিয়েছিল, তাকে কি আদৌ ধরা সম্ভব হয়েছে? এই প্রশ্নটুকু হয়তো তার মনে কিছুটা অস্বস্তি তৈরি করেছিল, কিন্তু গ্রামবাসীদের হাসিমুখ দেখে সে আপাতত সেই ভাবনা দূরে সরিয়ে রাখল। সে বিশ্বাস করল, সত্য কখনোই অন্ধকারে বেশিদিন লুকিয়ে থাকতে পারে না। একদিন সেই আসল সত্যও সামনে আসবেই।
শেষ অন্ধকারের মুখোশ উন্মোচন
বড়ি সাহেবের বাড়িটা পুলিশ বন্ধ করে দেওয়ার পর গ্রামে ধীরে ধীরে শান্তি ফিরে এল। বিজনবাবু ও অন্যরা গ্রেফতার হওয়ার পরে গ্রামবাসীদের মনে আতঙ্কের ছায়া কাটতে শুরু করল। তবুও, রাহুলের মনের গভীরে একটা সংশয় রয়ে গিয়েছিল—সেই আসল অপরাধী, যার নির্দেশে সবকিছু পরিচালিত হয়েছে, তাকে কি সত্যিই ধরা গেছে?
সেদিন বিকেলে রাহুল গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে দেখা পেল ডাক্তার অনির্বাণের। ডাক্তারবাবু তাকে দেখেই হেসে উঠে বললেন, “অভিনন্দন মাস্টারমশাই, আপনি তো গ্রামের হিরো হয়ে উঠলেন!”
রাহুল সামান্য হেসে বলল, “ধন্যবাদ, তবে আমার মনে এখনও কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে।”
ডাক্তারবাবু চোখ কুঁচকে বললেন, “কী প্রশ্ন?”
রাহুল একটু থেমে সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই পুরো ঘটনার মধ্যে একজন মানুষের ভূমিকা এখনও আমার কাছে পরিষ্কার নয়। আপনার ভূমিকা।”
ডাক্তার অনির্বাণের মুখ থেকে হাসিটা মুহূর্তেই উধাও হলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে তিনি ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “আপনি কী বলতে চাইছেন?”
রাহুল শান্ত গলায় বলল, “ডাক্তারবাবু, গ্রামের মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথম আপনি তাদের চিকিৎসা করতেন। অথচ, এতদিনের এই রহস্যময় অসুস্থতার আসল কারণ আপনার অজানা থাকার কথা নয়।”
ডাক্তার অনির্বাণ দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “আপনি অনেক বেশি বুদ্ধিমান, মাস্টারমশাই। ঠিকই ধরেছেন।”
“তার মানে…?” রাহুলের কণ্ঠে উত্তেজনা।
“আমি এই ওষুধের পুরো প্রকল্পটা পরিকল্পনা করেছিলাম। বিজনদা এবং অন্যরা কেবল আমার হাতের পুতুল ছিল। ওরা ছিল গ্রামে পরীক্ষার মাধ্যম মাত্র। কিন্তু আমি জানতাম, একদিন সত্য সামনে আসবেই।” ডাক্তারবাবু শান্ত, নির্লিপ্ত স্বরে বললেন।
“কিন্তু কেন এমন করলেন?” বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইল রাহুল।
“অর্থ, সম্মান, ক্ষমতা। আমার ওষুধ আবিষ্কারে সফল হলে বিশাল লাভ হতো। কিন্তু ভুল হয়ে গেল।” ডাক্তারবাবুর মুখে হালকা হতাশার ছাপ।
রাহুল নির্দ্বিধায় বলল, “আপনি গ্রামের নিরীহ মানুষগুলোর জীবন নিয়ে খেলেছেন। আপনাকে এর শাস্তি পেতে হবে।”
ডাক্তারবাবু হালকা হাসলেন, “আমি জানি। আমি অপেক্ষাই করছিলাম আপনার জন্য।”
পরদিন সকালেই রাহুলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পুলিশ গ্রামে এসে ডাক্তার অনির্বাণকে গ্রেফতার করল। পুরো ছায়াপুর গ্রাম হতবাক হয়ে দেখল, গ্রামের সবচেয়ে সম্মানিত, শ্রদ্ধেয় ডাক্তারবাবুই ছিলেন আসল পরিকল্পনাকারী।
এবার সত্যিই ছায়াপুর গ্রামের অন্ধকার রহস্যের পুরোপুরি অবসান হলো। গ্রামবাসীরা আবার নতুন আশায় সামনে তাকাল, আর রাহুল ও মিলি মিলে শুরু করল নতুন দিনের সূচনা।
রাহুলের জনপ্রিয়তা ও গ্রামে গ্রহণযোগ্যতা
গ্রামের দীর্ঘদিনের রহস্য উন্মোচনের পর, ছায়াপুর গ্রামের মানুষের চোখে রাহুল হয়ে উঠল একজন নায়ক। যে মানুষগুলো শুরুতে তার আগমনকে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের চোখে দেখেছিল, আজ তারাই তাকে গ্রহণ করল গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়।
বাজারের দোকানে, স্কুলের মাঠে, এমনকি গ্রামের পথে হাঁটার সময়েও সবাই রাহুলকে দেখলেই হাসিমুখে সম্মান জানাত। প্রবীণরা মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করতেন, আর গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাকে দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠত।
এক বিকেলে গ্রামের মাঠে বসে গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি বললেন, “মাস্টারমশাই, আপনি না এলে আমরা কোনোদিন সত্য জানতে পারতাম না। আপনার মতো মানুষই আমাদের গ্রামের খুব দরকার।”
রাহুল হাসি মুখে বলল, “আমি শুধু আমার কর্তব্যটা পালন করেছি। কিন্তু গ্রামে আসার পর বুঝেছি, এখানকার মানুষজনের জন্য আসলে শিক্ষার আলোটা খুব জরুরি।”
“আপনি যা ভালো বুঝবেন, করুন। গ্রামবাসী আপনাকে সবরকম সাহায্য করবে,” গ্রামের প্রবীণরা দৃঢ়তার সাথে বললেন।
সেদিন থেকেই রাহুল নতুন উদ্যমে স্কুলে পাঠদান শুরু করল। গ্রামবাসীরা সবাই এগিয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়াল। স্কুলঘরটাকে আরও ভালো করে মেরামত করা হলো। ছোট্ট একটা লাইব্রেরিও তৈরি করল গ্রামের মানুষ।
প্রতিদিন স্কুলের শেষে গ্রামের মাঠে বসে রাহুল গ্রামের ছেলে-মেয়েদের বই পড়ানো, গল্প বলা, আর বিজ্ঞানের বিভিন্ন রহস্য বুঝিয়ে দিতে শুরু করল। গ্রামের মানুষও ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, প্রকৃত আলো ভূত-প্রেতের গল্পে নয়—আলো থাকে শিক্ষার মধ্যেই।
রাহুলের উদ্যোগে ছায়াপুর গ্রামের জীবনটা ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করল। সেই রহস্যের অন্ধকার কাটিয়ে, গ্রামের আকাশে এবার নতুন দিনের আলো দেখা দিল। আর রাহুলের চোখে তখন নতুন এক স্বপ্নের আলো—গ্রামটাকে নতুনভাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন।
সুন্দর সমাপ্তি
রহস্যের মেঘ কেটে যাওয়ার পর ছায়াপুর গ্রামে যেন নতুন সূর্যের উদয় হলো। গ্রামের মানুষগুলো এতদিন যে ভয় আর অবিশ্বাসের মধ্যে দিন কাটিয়েছিল, সেই ছায়া কাটিয়ে তারা আবার আশার আলোয় এগিয়ে যেতে শুরু করল।
রাহুল আর মিলির প্রচেষ্টায় গ্রামের স্কুলের পাশেই তৈরি হলো নতুন একটি ছোট লাইব্রেরি—নাম দেওয়া হলো “আলোক দিশারী গ্রন্থাগার”। গ্রামের সবাই আনন্দ ও উৎসাহ নিয়ে নিজেরা হাতে হাতে কাজ করল লাইব্রেরি তৈরি করতে। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বই হাতে নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করল।
রাহুল প্রতিদিন স্কুলের পর ছেলেমেয়েদের নিয়ে গল্পের আসর বসাত। সেখানে বিজ্ঞানের রহস্য, ইতিহাসের রোমাঞ্চকর গল্প, এমনকি শহরের জীবন নিয়েও আলোচনা হতো। গ্রামের প্রতিটি ঘরে আলো ছড়াতে লাগল সেইসব গল্প ও শিক্ষা।
মিলি নিজেও বড় হয়ে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। সে বলত, “স্যার, আমি আপনার মতো শিক্ষক হবো। আপনার মতই মানুষের মনে আলো জ্বালাবো।”
রাহুল হাসিমুখে বলত, “আমি বিশ্বাস করি, তুমি একদিন আমার চেয়েও ভালো শিক্ষক হবে।”
এভাবেই ছায়াপুর গ্রামে শিক্ষার আলো, নতুন স্বপ্ন, আর আশা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। গ্রামের মানুষরাও বুঝতে পারল, সত্যিকারের উন্নতি ও শান্তি আসে শুধু শিক্ষার মাধ্যমে।
বছরের পর বছর কেটে যাবে, কিন্তু গ্রামবাসী কখনোই ভুলবে না সেই তরুণ শিক্ষককে, যার সাহস, নিষ্ঠা, আর ভালোবাসায় তারা ফিরে পেয়েছে নতুন জীবন।
সন্ধ্যা নামলে গ্রামের বাতাসে আর আগের মতো আতঙ্ক নয়, বরং ভেসে আসে বইয়ের পাতার গন্ধ, ভেসে আসে স্বপ্ন দেখার সাহস।
ছায়াপুর গ্রাম নতুন দিনের দিকে এগিয়ে চলে, তার গল্পের নতুন পাতাগুলো তৈরি করতে।