অধ্যায় ১: অদ্ভুত মৃত্যু
কলকাতার বুকে সন্ধে নামছিল, আকাশের গায়ে তখন হালকা রঙের মায়ামাখা আঁচড়। রাস্তায় গাড়ির ভিড় তখনও প্রচুর। এরই মাঝে বালিগঞ্জের অন্যতম অভিজাত এলাকা “আইভি রেসিডেন্সি”-র বাইরে আচমকা জমে উঠেছে প্রচণ্ড ভিড়। মূল গেটের সামনে কয়েকটা পুলিশের গাড়ি, মিডিয়ার ক্যামেরা আর রিপোর্টারদের ভিড় দেখে পথচারীরাও দাঁড়িয়ে গেছে।
কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁগো, কী হয়েছে এখানে?”
“ওই নামকরা অভিনেত্রী, অরুণিমা সেনগুপ্ত, মারা গেছেন। শুনলাম আত্মহত্যা,” উত্তর এলো ভিড়ের ভেতর থেকে।
কথাটা দ্রুত হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ল। সোশ্যাল মিডিয়া আর টিভি চ্যানেলগুলো যেন মুহূর্তে মেতে উঠল এই চাঞ্চল্যে। লাইভ রিপোর্ট শুরু হয়ে গেল একটার পর একটা।
“এই মুহূর্তে আমরা রয়েছি বালিগঞ্জের আইভি রেসিডেন্সি-র বাইরে। বিখ্যাত অভিনেত্রী অরুণিমা সেনগুপ্তকে তাঁর ফ্ল্যাটে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। প্রাথমিক ভাবে পুলিশ মনে করছে, এটি আত্মহত্যা…”
ফ্ল্যাটের ভিতরে তখন পুলিশের কর্মকাণ্ড তুঙ্গে। বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স অ্যাপার্টমেন্টের দ্বিতীয় তলায় বিশাল বেডরুমে বিছানার ওপর পড়ে আছে অভিনেত্রী অরুণিমা সেনগুপ্তের নিথর দেহ। পাশে একটা ছোট ওষুধের বোতল, কয়েকটা ট্যাবলেট ছড়ানো বিছানায়। বিছানার পাশেই পড়ে আছে অরুণিমার মোবাইল। ঘরজুড়ে হালকা একটা সুগন্ধি ছড়ানো, কিন্তু পরিবেশটা থমথমে।
ঘরে দাঁড়ানো পুলিশ অফিসার সুজয় ঘোষের ভ্রু কুঁচকে গেছে। “দেখেছো, শরীরের কোথাও কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই,” পাশের ফরেনসিক অফিসারকে বললেন তিনি।
“হুম, তবে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার মতো মনে হচ্ছে।” ফরেনসিক এক্সপার্ট সন্দীপ দত্ত গ্লাভস পরে মৃতদেহের মুখে আলো ফেলতে ফেলতে বললেন।
“পোস্টমর্টেমের আগে কিছু বলা ঠিক হবে না,” সুজয়বাবু মাথা নাড়লেন, “ওষুধটা কোনো প্রেসক্রিপশন ছাড়াই নেওয়া হয়েছিল নাকি, সেটা জানা দরকার। আর এই বিখ্যাত অভিনেত্রী কেনই বা আত্মহত্যা করবেন, সেটাও ভাবার বিষয়।”
সেদিন দুপুর পর্যন্ত শুটিং করেছেন অরুণিমা। সহকর্মীরা জানিয়েছেন, তিনি স্বাভাবিকই ছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় একটা পার্টিতে যাওয়ার কথাও ছিল। তাহলে আচমকা কেন?
কিছুক্ষণ পরে বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটি গার্ড সুধীর সরকারকে ডাকলেন অফিসার। “আপনিই প্রথম দেখেছিলেন?”
“হ্যাঁ স্যার, রাত আটটা নাগাদ অরুণিমা ম্যাডামের অ্যাসিস্ট্যান্ট মঞ্জরীদি এসে ডাকাডাকি শুরু করেন। দরজা ভেতর থেকে লক ছিল, ফোনও ধরছিলেন না। আমরা বাধ্য হয়ে দরজা ভাঙি, তারপর তো দেখতেই পাচ্ছেন…” কণ্ঠে উদ্বেগ নিয়ে বললেন সুধীর।
সুজয়বাবু ঘুরে তাকালেন অভিনেত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী মঞ্জরী রায়ের দিকে। “কী ব্যাপার, উনি কি কোনো কারণে ডিপ্রেশনে ছিলেন?”
মঞ্জরী রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “না স্যার, ম্যাডাম খুবই হাসিখুশি ছিলেন। আজ তো শুটিংয়ে দারুণ পারফর্ম করলেন। বিকেলে আমাকে নিজে বলেছিলেন, সন্ধ্যার পার্টির জন্য রেডি হতে। কেন এমন করবেন, বুঝতে পারছি না!”
সুজয়বাবু চিন্তিত মুখে ফের ঘরটায় তাকালেন। চারপাশের জিনিসপত্র নিখুঁতভাবে সাজানো, অরুণিমার ব্যক্তিত্বের মতোই মার্জিত। বিছানার পাশে ছোট টেবিলের ওপর তাঁর শেষ পড়া বইটা—একটা ক্লাসিক ইংরেজি উপন্যাস—যেন একটা চিরাচরিত সন্ধেরই ছবি। তবু কোথাও যেন একটা অসঙ্গতি আছে।
ঠিক এই সময়ে ফরেনসিক টিমের একজন হঠাৎ করে কিছু একটা আবিষ্কার করে চেঁচিয়ে উঠলেন, “স্যার, এটা দেখুন!”
সুজয়বাবু কাছে এগিয়ে গেলেন। টেবিলের এক কোণে খুব সাবধানে রাখা একটা ছোট্ট প্লাস্টিক কেস, ভেতরে নীল রঙের এক জোড়া কন্টাক্ট লেন্স।
“অরুণিমা সেনগুপ্ত কি কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহার করতেন?” জিজ্ঞেস করলেন অফিসার।
মঞ্জরী চোখ বড় করে বললেন, “একদম না স্যার! ম্যাডামের চোখে তো কোনো পাওয়ার ছিল না। আর উনি নীল রঙের লেন্স কেনই বা ব্যবহার করবেন!”
ঘরের ভেতরে যেন একটা অন্যরকম চাপা উত্তেজনা তৈরি হলো। রহস্যটা হঠাৎ গভীর হতে শুরু করল।
এই অদ্ভুত নীল লেন্স এখানে কেন? কারও উপস্থিতি কি লুকিয়ে আছে এই নির্জন, নিঃস্তব্ধ মৃত্যুর পেছনে?
সুজয়বাবু এবার বেশ জোর গলায় বললেন, “প্রাথমিক রিপোর্ট যা-ই হোক, ব্যাপারটা যত সহজ মনে হচ্ছে তত সহজ নয়। এটা আত্মহত্যা হোক বা হত্যা—আমাদের ভালোভাবে তদন্ত করতে হবে। ঘটনাটা এবার অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে।”
বাইরে তখনও মিডিয়ার ভিড়। সোশ্যাল মিডিয়া, ফেসবুক-টুইটার ভরে উঠছে অরুণিমার স্মৃতি আর অজস্র প্রশ্নে। ঠিক কী হয়েছিল সেই সন্ধ্যায়?
বালিগঞ্জের রাতটা সেদিন একটু বেশিই রহস্যময় হয়ে উঠল।
অধ্যায় ২: নীলচোখের ছায়া
রাতটা কলকাতার জন্য বড়ো লম্বা হলো। টিভি-ইন্টারনেটে ভেসে বেড়াচ্ছে হাজারটা প্রশ্ন, অনুমান, আর আলোচনা। অভিনেত্রী অরুণিমা সেনগুপ্তের মৃত্যু—আত্মহত্যা না হত্যা? সোশ্যাল মিডিয়ায় #JusticeForArunima হ্যাশট্যাগ ভাইরাল হয়ে গেছে। কেউ বলছে রহস্যজনক মৃত্যু, কেউ দাবি করছে এটা ষড়যন্ত্র।
পরদিন সকাল দশটা নাগাদ আইভি রেসিডেন্সির সামনে ভিড় আবার বাড়তে শুরু করল। পুলিশ, ফরেনসিক টিম, সাংবাদিকরা সবাই নিজেদের মতো তথ্য জোগাড় করছে। এর মাঝেই এলেন ক্রাইম ব্রাঞ্চের এক উচ্চপদস্থ অফিসার—অরিন্দম নন্দ। তাঁর সঙ্গে ছিল বছর পঁচিশের এক তরুণ। লম্বা, ফর্সা, চেহারায় বুদ্ধিদীপ্ত ছাপ। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে একটা নোটবুক। পরনে হালকা নীল শার্ট আর জিন্স। বেশ মৃদু হাসি মুখে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল সে।
“কে রে ছেলেটা?” মিডিয়ার এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করল।
পাশে থাকা অফিসার জবাব দিলেন, “অরিন্দম স্যারের ভাইপো। নাম সোহম নন্দ, যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে আইনের ছাত্র। শুনেছি মাথাটা খুব ভালো, মামার সাথে মাঝে মাঝে তদন্তে সাহায্য করে।”
ওদিকে, অরুণিমার অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে অরিন্দম নন্দ সোহমের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “খুব কঠিন কেস, সোহম। অনেক চাপ আসছে, মিডিয়াও খুব সক্রিয়। আমাকে সাহায্য করবি?”
সোহম শান্ত গলায় বলল, “অবশ্যই কাকু। কিন্তু আমার কিছু প্রশ্ন আছে। প্রথমে গতকালের ঘটনাটা একটু পরিষ্কার করে বলো।”
অরিন্দম নন্দ বিস্তারিতভাবে বললেন গতকালের ঘটনার সবকিছু—অতিরিক্ত ওষুধের বিষয়, সহকারী মঞ্জরীর বক্তব্য, নিরাপত্তারক্ষীর কথাবার্তা—সবই। শেষে সোহম বলল, “তাহলে তো ব্যাপারটা সরল মনে হয়েছিল, কিন্তু নীল কন্টাক্ট লেন্সটা সব হিসাব বদলে দিচ্ছে।”
“সেটাই তো,” অরিন্দম চিন্তিতভাবে বললেন, “এখানে সন্দেহভাজন হিসেবে বেশ কয়েকজন আছে। কিন্তু প্রমাণ বা মোটিভ পরিষ্কার নয়।”
সোহম এবার ধীরে ধীরে ঘরের চারদিকে তাকাল। তারপর গ্লাভস পরে কেস থেকে সেই নীল কন্টাক্ট লেন্সটা হাতে নিল। আলোর নিচে ভালো করে পরীক্ষা করল কিছুক্ষণ। “একটা জিনিস খেয়াল করেছো কাকু?”— সোহম হঠাৎ প্রশ্ন করল।
“কী রে?”
“লেন্সটা ব্যবহার করা হয়নি কখনো। একেবারে নতুন। আর এগুলো সাধারণ লেন্স নয়, দামি, বিশেষ ধরনের লেন্স। স্পেশাল ইফেক্ট বা পার্টির জন্য ব্যবহৃত হয়। সাধারণ মানুষ এটা রোজ ব্যবহার করবে না। তাহলে এটা কেনই বা এখানে এলো?” সোহম খুব গভীরভাবে বলল।
“মানে, তোর ধারণা কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এখানে রেখেছে?” অরিন্দম জিজ্ঞেস করলেন।
“সম্ভব। আবার হয়তো কোনো ধরনের সংকেত দিতেও পারে।” সোহম বলল। এরপর সে গ্লাভস খুলে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে কাছ থেকে কার্পেট দেখতে লাগল। সে হঠাৎ মোবাইলের টর্চ অন করল, ঘরের ছোট ছোট ডিটেইলস ভালো করে দেখল।
“পেলি কিছু?” অরিন্দম নন্দ কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন।
“একটা প্রশ্ন মাথায় এসেছে। অভিনেত্রী ঘুমের ওষুধ নিয়েছেন ঠিক আছে, কিন্তু ঘরটা এত নিখুঁতভাবে গুছানো, যেন আগে থেকেই সব প্রস্তুত ছিল। দরজা বন্ধ, ওষুধ পাশে, বিছানা পরিপাটি। কিন্তু তাঁর ফোনটা পড়ে ছিল মেঝেতে। একজন মানুষ যখন ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ে, তার ফোন এত দূরে পড়ে থাকবে কেন?”
অরিন্দম গভীর চিন্তায় পড়লেন, “এটা একটা বড় প্রশ্ন। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এলেই জানা যাবে, উনি মারা যাওয়ার আগে কারও সঙ্গে কথা বলেছিলেন কিনা।”
সোহম এবার অভিনেত্রীর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি দেখতে গেল। বইয়ের তাকে চোখ বুলাতে বুলাতে সে একটা বিশেষ বই বের করল। বইটার ভেতরে একটা ছবি। ছবিতে দুজন—অরুণিমা ও আরেকজন অচেনা পুরুষ। লোকটার চেহারা অস্পষ্ট, চোখ দুটো হালকা নীলাভ।
সোহম বিস্ময়ে বলল, “কাকু, দেখো! ছবিতে অরুণিমা কার সঙ্গে?”
অরিন্দম ছবি দেখে কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর বললেন, “এই লোকটাকে আগে দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না। ছবিটার তারিখ লেখা আছে?”
ছবির পেছনে তারিখ লেখা—”১৮/১১/২০২৩, শান্তিনিকেতন।”
সোহম গম্ভীর হয়ে বলল, “মাত্র কয়েক মাস আগের ছবি। শান্তিনিকেতনে কোনো সূত্র পেলে ভালো হয়।”
ঠিক সেই মুহূর্তেই ফরেনসিক অফিসার সন্দীপ দত্ত ঘরে ঢুকলেন রিপোর্ট নিয়ে। “স্যার, অদ্ভুত ব্যাপার। অভিনেত্রীর শরীরে শুধু ঘুমের ওষুধ নয়, সঙ্গে পাওয়া গেছে অল্প পরিমাণে অজানা কোনো টক্সিন। যা সাধারণত পাওয়া যায় না।”
অরিন্দম চমকে উঠলেন। “মানে, এটা খুন?”
“খুব সম্ভব,” সন্দীপ দত্ত বললেন।
সোহমের চোখে এবার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ঝিলিক দেখা দিল।
“তাহলে এবার শান্তিনিকেতনে যেতেই হবে, কাকু। আসল রহস্যের শুরু হয়তো সেখান থেকেই।”
কলকাতার আকাশ তখন মেঘলা। রহস্যের ঘনঘটা এবার পুরোপুরি তৈরি। সোহম জানে, সামনে আরও বড় কিছু অপেক্ষা করছে।
অধ্যায় ৩: সোহম নন্দ—এক উজ্জ্বল মস্তিষ্ক
সোহম জানত, অরুণিমার মৃত্যুর তদন্তে শান্তিনিকেতন যেতেই হবে। কিন্তু তার আগে কলকাতায় ফেরার পথে সে মনে মনে কিছু প্রশ্ন সাজিয়ে নিচ্ছিল। গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখছিল ব্যস্ত শহরের ভিড়, আর ভাবছিল—এই রহস্যটা কত গভীরে পৌঁছাতে পারে। আসলে রহস্যের শিকড় সব সময়েই মানুষের মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকে, যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না।
বালিগঞ্জ থেকে গাড়িতে বাড়ি পৌঁছতেই দেখল তার ছোট ভাই শুভ্র দরজা থেকেই চেঁচিয়ে বলছে, “দাদা, কী ব্যাপার? টিভিতে তোর নাম শুনলাম যে! তুই সেই অভিনেত্রীর মৃত্যুর তদন্তে নেমেছিস?”
“খবরটা তুই কাকিমাকে জানাসনি তো আবার?” সোহম একটু চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করল।
“না না, মা আর বাবা বেরিয়েছে নিউমার্কেটে। ওরা জানে না কিছু,” শুভ্র গম্ভীর গলায় জানাল।
সোহম কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের ঘরে গেল। ঘরের চারদিকে বই, কিছুটা অগোছালো, কিন্তু এমনভাবেই তার মাথার ভেতরে চিন্তাগুলোকে সে সাজিয়ে রাখে। টেবিলের ওপর একটা খোলা নোটবুক। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে সে নোটবুকের একটা নতুন পাতায় বড় বড় করে লিখল—”নীলচোখ”। এরপর কিছু প্রশ্ন লিখে নিল:
অরুণিমার মৃত্যুর কারণ কী শুধুই ঘুমের ওষুধ, নাকি অন্য কিছু?
নীল রঙের কন্টাক্ট লেন্সের রহস্য কী? এটি কি সংকেত?
শান্তিনিকেতনের ছবির অচেনা লোকটির পরিচয় কী?
লেখা শেষ করে সে কিছুটা সময় চুপ করে রইল। শুভ্র এসে দরজায় দাঁড়িয়ে মৃদু গলায় বলল, “দাদা, একটা কথা বলব?”
“বল না,” মাথা না তুলে উত্তর দিল সোহম।
“তোর এসব তদন্ত আমার খুব ইন্টারেস্টিং লাগে। আমিও কি তোকে একটু সাহায্য করতে পারি?” শুভ্র উৎসাহ নিয়ে বলল।
সোহম এবার হেসে উঠে বলল, “তোকে লাগবে ঠিকই। কিন্তু আগে তোর পরীক্ষা শেষ কর। তোর পরীক্ষার পরে তোকে প্রোমিস করছি একটা সত্যিকারের তদন্তে নিয়ে যাব।”
শুভ্রের চোখ আনন্দে চকচক করে উঠল। সে উত্তেজিত গলায় বলল, “দাদা, আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি? তুই কেন বললি, নীল লেন্সটা সংকেত হতে পারে?”
সোহম মৃদু হেসে বলল, “দেখ, একটা জিনিস মনে রাখবি। কোনো কিছুই বিনা কারণে হয় না। একজন অভিনেত্রী, যিনি নীল লেন্স ব্যবহার করেন না, তাঁর ঘরে নীল লেন্স এল কোথা থেকে? এটা এমন একজন রেখে গেছে, যার চোখ নীল নয়, কিন্তু সে বুঝিয়েছে অন্য কিছু। অর্থাৎ সে চেয়েছে যেন ওই নীল চোখকে কেউ লক্ষ করে। এটা একধরনের Symbolism, যেটা পরিকল্পিত অপরাধে সচরাচর দেখা যায়।”
শুভ্র অবাক হয়ে বলল, “তাহলে ব্যাপারটা গভীর?”
“খুবই গভীর,” সোহম নিশ্চিত গলায় বলল।
ঠিক তখনই সোহমের ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে নাম দেখেই সে ফোন ধরল—”হ্যাঁ কাকু, বলো।”
ওপাশ থেকে কাকা অরিন্দম নন্দ গম্ভীর গলায় বললেন, “সোহম, শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আগে একটা কাজ কর। অভিনেত্রীর অ্যাসিস্ট্যান্ট মঞ্জরী রায়ের সঙ্গে দেখা কর। ওর কথায় বেশ কিছু অসঙ্গতি পেয়েছি। মনে হচ্ছে ও কিছু লুকোচ্ছে।”
“কী ধরনের অসঙ্গতি, কাকু?”—সোহম আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল।
অরিন্দমবাবু বললেন, “গত কয়েকমাস ধরে মঞ্জরীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নিয়মিত বড় অঙ্কের টাকা জমা পড়েছে। অরুণিমার মৃত্যুর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে।”
“ঠিক আছে কাকু। আমি কালই মঞ্জরীর সঙ্গে দেখা করব। তারপর শান্তিনিকেতন যাব।”
ফোন রাখার পর সোহম আবার নোটবুকের পাতায় নতুন লাইন লিখল—
মঞ্জরী রায়—আর্থিক লেনদেন? মোটিভ?
এই সময় বাইরে থেকে গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। বাবা-মা ফিরেছে। সোহম ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িংরুমে গেল। ওর বাবা অমিতাভ নন্দ ও মা সুপর্ণা নন্দ সোফায় বসে ক্লান্ত হয়ে গল্প করছেন।
“কী রে, শুনলাম তুই কোনো বড় তদন্তে জড়িয়ে গেছিস?” বাবা একটু চিন্তিত মুখে বললেন।
“না না, বাবা। অত বড় কিছু নয়। কাকুকে একটু সাহায্য করছি,” সোহম সহজভাবেই ব্যাপারটা হালকা করতে চাইল।
মা একটু উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, “যাই করিস, খুব সাবধানে করিস। তোর কাকা পুলিশে আছে, ওর ব্যাপারটা অন্য। তুই তো আর প্রফেশনাল গোয়েন্দা নোস।”
“দেখো মা, আমি আইন নিয়ে পড়ছি, আমার কাজ সত্যিটা খুঁজে বার করা। তদন্তটা তাই একরকম আমার পড়ারই অংশ। আর আমি জানি, কতটা সাবধান হতে হবে,” সোহম আত্মবিশ্বাস নিয়ে হাসল।
বাবা-মা নিশ্চিন্ত হওয়ার চেষ্টা করলেও তাদের চোখে চিন্তার ছাপ ছিল স্পষ্ট। সোহম বুঝতে পারছিল, সামনের দিনগুলো আরও জটিল হতে চলেছে। কিন্তু সে পিছিয়ে আসার মানুষ নয়। সত্যের মুখোমুখি হতেই হবে তাকে।
পরের দিন সকালে সে তৈরি হয়ে নিল মঞ্জরী রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। রহস্যের প্রথম আসল সূত্রটা বোধহয় এখানেই পাওয়া যাবে।
অধ্যায় ৪: কাকার অনুরোধ—তদন্তে সোহম
সোহম মঞ্জরী রায়ের ঠিকানাটা আগেই জোগাড় করেছিল। দুপুর নাগাদ সে পৌঁছাল যোধপুর পার্কের একটা ছোট ফ্ল্যাটে। বহুতল নয়, পুরনো ধরনের তিনতলা বাড়ি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ফ্ল্যাটের দরজার বেল বাজাল। কয়েক সেকেন্ড পর দরজা খুললেন মঞ্জরী নিজেই। তাঁর চোখ-মুখ ফ্যাকাশে, উদ্বেগ আর ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ।
“আপনিই মঞ্জরী রায়?” বিনীত স্বরে জিজ্ঞেস করল সোহম।
“হ্যাঁ…আপনি?” কিছুটা ইতস্তত করে প্রশ্ন করলেন তিনি।
“আমি সোহম নন্দ, অরিন্দম নন্দের ভাইপো। তদন্তের ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন ছিল আপনার কাছে,” শান্ত গলায় জানাল সোহম।
মঞ্জরী কিছুটা হতবাক হলেন, তারপর ভেতরে আসতে বলে দরজা বন্ধ করলেন। ঘরে ঢুকে সোহম চারপাশটা নজর করল। খুব সাধারণ একটা বসার ঘর, মাঝখানে টেবিল, দু’পাশে সোফা, একটা দেওয়ালে অভিনেত্রী অরুণিমা সেনগুপ্তের সাথে মঞ্জরীর একটি ছবি।
মঞ্জরী টেবিলে গ্লাসে জল দিয়ে বললেন, “বলুন, কী জানতে চান?”
সোহম এবার সরাসরি প্রশ্নে চলে গেল। “মঞ্জরীদেবী, আপনার অ্যাকাউন্টে গত কয়েক মাসে বেশ বড় অঙ্কের টাকা এসেছে। এই টাকাগুলো কার দেওয়া, বলতে পারবেন?”
মঞ্জরীর মুখ মুহূর্তেই বদলে গেল। একটু থতমত খেয়ে বললেন, “কী টাকা? আমি ঠিক বুঝলাম না…”
সোহম স্মিত হেসে বলল, “দেখুন, পুলিশ ব্যাংকের স্টেটমেন্ট দেখেছে। আপনার অ্যাকাউন্টে গত পাঁচ মাসে মোট তিরিশ লক্ষ টাকা জমা হয়েছে। প্রতি মাসে ছয় লক্ষ টাকা করে। একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে এটা অনেক বেশি, তাই না?”
মঞ্জরী কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “এটা… এটা একেবারেই ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি বলতে পারব না…”
সোহম এবার একটু এগিয়ে ঝুঁকে বলল, “দেখুন, এটা খুনের তদন্ত। কোনো কিছুই ব্যক্তিগত নয়। আমার মনে হয় না আপনি অরুণিমাদেবীর খুনের সাথে জড়িত। কিন্তু সত্য না জানালে, সন্দেহ আপনার দিকেই যাবে।”
মঞ্জরী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “ঠিক আছে। এই টাকাটা আমাকে দিয়েছেন রঞ্জন বোস। ব্যবসায়ী রঞ্জন বোস, নিশ্চয়ই নাম শুনেছেন।”
সোহম মনোযোগী হয়ে উঠল। “কেন দিয়েছেন?”
মঞ্জরী দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললেন, “অরুণিমা ম্যাডামের আর রঞ্জন বোসের মধ্যে একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সম্প্রতি তাদের মধ্যে ঝামেলা হয়। ম্যাডাম সম্পর্কটা শেষ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু রঞ্জন সেটা চাইছিলেন না। রঞ্জন আমাকে বলেছিল, ওদের সম্পর্কটা ঠিক করতে। এই টাকাটা ছিল ওই কাজের বিনিময়ে। আমি খুব খারাপ অবস্থায় ছিলাম, টাকাটা দরকার ছিল বলে নিয়ে নিয়েছিলাম।”
“তার মানে, আপনি ওঁদের সম্পর্ক জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছিলেন?” জিজ্ঞেস করল সোহম।
মঞ্জরী মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ, চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ম্যাডাম কিছুতেই রাজি হননি। উনি রঞ্জন বোসকে দেখে ভয় পেতেন। বলতেন, রঞ্জন নাকি খুব ভয়ঙ্কর মানুষ।”
“ভয়ঙ্কর? কীসের ভয়ঙ্কর?” সোহম কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করল।
“সেটা আমি জানি না। কিন্তু ম্যাডাম শুধু বলতেন, রঞ্জনের কিছু গোপন বিষয় উনি জেনে ফেলেছেন। সেই কারণেই ম্যাডাম বিচ্ছেদ চাইছিলেন।”
সোহম চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করল, “রঞ্জন বোসের সঙ্গে আপনার শেষ কখন যোগাযোগ হয়েছে?”
“গত পরশু রাতে, ম্যাডামের মৃত্যুর আগের দিন। আমাকে ফোনে খুব চাপ দিচ্ছিলেন যেন ম্যাডামকে রাজি করাই।” বললেন মঞ্জরী।
সোহম মনে মনে হিসাব মেলাল। অভিনেত্রীর মৃত্যুর আগের রাতে রঞ্জন বোসের এই ফোন কল একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
“ঠিক আছে, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ,” বলে উঠে দাঁড়াল সোহম।
দরজা পর্যন্ত পৌঁছে মঞ্জরী হঠাৎ পেছন থেকে ডেকে বললেন, “শুনুন, একটা কথা বলি। ওই দিন সন্ধেবেলায় ম্যাডামের ফ্ল্যাট থেকে বেরোনোর সময় একজনকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখেছিলাম। কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পাইনি।”
সোহম ঘুরে দাঁড়াল, “মানুষটাকে দেখতে কেমন ছিল মনে আছে?”
“না…শুধু এটুকু মনে আছে, লোকটার চোখ দুটো অদ্ভুত নীলাভ ছিল। এক মুহূর্তের জন্য দেখেছিলাম, কিন্তু ওটা খুব স্পষ্ট ছিল। যেন কৃত্রিম, অদ্ভুত এক নীলচোখ…” মঞ্জরীর কণ্ঠে হালকা আতঙ্ক।
সোহম নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। তার বুকের ভেতরটা দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল। আবারও সেই “নীলচোখ”—এইবার রহস্যটা যেন আরও গভীরে, আরও ভয়ঙ্কর রূপে হাজির হল।
অধ্যায় ৫: অভিনেত্রীর রহস্যময় ব্যক্তিগত জীবন
মঞ্জরী রায়ের কাছ থেকে বেরিয়ে সোহম সোজা চলে গেল যাদবপুরের নিজের ঘরে। বিকেল তখন গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে যাচ্ছে। আকাশে গাঢ় হয়ে নেমেছে কালো মেঘ। জানলার পাশে দাঁড়িয়ে সে চিন্তা করতে শুরু করল।
মঞ্জরীর কথাগুলো ওকে বেশ ভাবাচ্ছিল। “নীলচোখ” শব্দটা বারবার ফিরে আসছে। প্রথমে অভিনেত্রীর ঘরে সেই অদ্ভুত নীল লেন্স, তারপর সিঁড়িতে দেখা রহস্যময় নীলচোখের মানুষটা। দুটো ঘটনা কি সম্পর্কযুক্ত?
ভাবনায় ছেদ পড়ল ফোনের রিংটোনে। স্ক্রিনে নাম দেখল—কাকা অরিন্দম নন্দ।
“হ্যাঁ কাকু, বলো,” ফোন ধরল সোহম।
“তোর তদন্ত কেমন চলছে?” জানতে চাইলেন অরিন্দমবাবু।
সোহম সংক্ষেপে সবটা জানাল। মঞ্জরীর কথা, রঞ্জন বোসের আর্থিক লেনদেন, রহস্যময় নীলচোখ—সব।
অরিন্দম নন্দ গম্ভীর হয়ে বললেন, “তাহলে তো তোর পরের কাজ রঞ্জন বোসের সঙ্গে কথা বলা। তবে সাবধান, ও কলকাতার বড় ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী মানুষ।”
“আমি জানি, কাকু। তবে রঞ্জন বোস ছাড়াও একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লু আছে,” বলল সোহম।
“কী ক্লু?” কৌতূহলী হলেন অরিন্দম।
“অরুণিমার ঘরে পাওয়া শান্তিনিকেতনের ছবি। আমার মনে হচ্ছে, শান্তিনিকেতনেই আছে আসল সূত্র। রঞ্জনের সঙ্গে কথা বলে আমি সেখানে যাব,” দৃঢ় গলায় বলল সোহম।
“ঠিক আছে, তবে খুব সাবধান,” সতর্ক করলেন অরিন্দম নন্দ।
পরদিন সকালেই সোহম পৌঁছাল কলকাতার অভিজাত এক হোটেলে, রঞ্জন বোসের অফিসে। বিলাসবহুল অফিসের ভেতরে ঢুকতেই তাকে অভ্যর্থনা জানাল এক যুবতী।
“রঞ্জন স্যার আপনাকে ওঁর ঘরে অপেক্ষা করতে বলেছেন,” নম্র স্বরে জানালেন তিনি।
ঘরে ঢুকে চারপাশটা দেখল সোহম। অত্যন্ত বিলাসবহুল ঘর, দেওয়ালে দামি ছবি, একটা বড় ডেস্কের পেছনে বিশাল উইন্ডো থেকে দেখা যাচ্ছে কলকাতার আকাশ। মিনিট পাঁচেক পরেই এলেন রঞ্জন বোস। লম্বা, গৌরবর্ণ, দামী স্যুট পরা, চোখে তীক্ষ্ণ নজর।
“হ্যাঁ, আপনি নিশ্চয়ই সোহম নন্দ? শুনেছি আমার সাথে দেখা করতে চান?” রঞ্জন বসে জিজ্ঞেস করলেন।
“ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্য,” সৌজন্যমূলক কথা বলেই সোহম সরাসরি জিজ্ঞেস করল, “অরুণিমা সেনগুপ্তের মৃত্যুর ঘটনা আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন?”
“অবশ্যই,” বললেন রঞ্জন বোস, “খুবই দুঃখজনক। আমি হতবাক। উনি আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন।”
সোহম এবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, “শুধুই বন্ধু?”
রঞ্জনের চোখের মণি কিছুটা সরে গেল। সামান্য অস্বস্তি ফুটে উঠল মুখে। কিন্তু দ্রুত সামলে নিলেন, “আপনার ইঙ্গিতটা ঠিক কী?”
“ইঙ্গিত নয়, সরাসরি প্রশ্ন,” সোহম শান্ত স্বরে বলল, “আপনার সঙ্গে অরুণিমার একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল, যেটা উনি শেষ করতে চাইছিলেন।”
রঞ্জন কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেন। সামান্য রেগে বললেন, “দেখুন, এটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়।”
“কিন্তু ঘটনাটা এখন আর ব্যক্তিগত নেই। কারণ আপনার আর অরুণিমার সম্পর্ক নিয়ে তাঁর সহকারী মঞ্জরীকে নিয়মিত টাকা দিচ্ছিলেন আপনি,” সোহম কথাগুলো স্পষ্ট করে বলল।
রঞ্জন বোস মুহূর্তে থেমে গেলেন। ধীরে ধীরে মুখটা কঠোর হয়ে উঠল। হঠাৎ করেই হেসে উঠলেন তিনি, “আপনার সাহস আছে মানতেই হবে। ঠিক আছে, সত্যিটা বলছি। হ্যাঁ, অরুণিমার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেটা আমাদের দুজনের সম্মতিতেই। আর ও যদি শেষ করতে চাইত, তাতে আমার আপত্তি ছিল না। মঞ্জরীকে টাকা দিয়েছিলাম কারণ সে বলেছিল ও আমাদের সম্পর্ক ঠিক করে দিতে পারবে।”
“কিন্তু অরুণিমা নাকি আপনাকে ভয় পেতেন,” সোহম সরাসরি বলল।
রঞ্জনের মুখে অদ্ভুত এক হাসি ফুটল, “অরুণিমা আমাকে ভয় পেত? অদ্ভুত। ও আসলে আমার সম্পর্কে এমন কিছু জানত যা ওর না জানলেই ভালো ছিল।”
সোহম চমকে উঠল, “কী জানতেন অরুণিমা?”
রঞ্জন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “ও আমার ব্যবসার একটা গোপন বিষয় জেনে গিয়েছিল। তবে আমার ওকে মেরে ফেলার কোনো কারণ নেই। আমি ব্যবসায়ী, অভিনেত্রীকে মেরে আমার লাভ কী?”
“আপনার ব্যবসার সেই গোপন বিষয়টা কী?” জিজ্ঞেস করল সোহম।
“সেটা বলা যাবে না,” রঞ্জন পরিষ্কার জানালেন। “কিন্তু আমার পরামর্শ, তদন্তটা আর না এগোনোই ভালো। কারণ সত্যিটা হয়তো আপনার বা অন্য কারোর জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।”
সোহম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। তবে সত্য আমার কাছে বিপদের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ।”
রঞ্জন বোস গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তার চোখে স্পষ্ট একটা চাপা ক্রোধ। সোহম বুঝতে পারল, এ লোক সহজ নয়। এখানেই লুকিয়ে আছে গভীর কোনো সত্য।
ঘর থেকে বেরিয়ে সোহম শান্তিনিকেতনের ট্রেনে উঠল। এই রহস্যের শেষটা এখানেই নয়, বরং এখান থেকেই শুরু।
অধ্যায় ৬: সন্দেহের তালিকা বাড়ছে
শিয়ালদহ থেকে শান্তিনিকেতনের ট্রেনে উঠেই জানলার ধারে সিট নিয়ে বসল সোহম। ট্রেনের হালকা দুলুনিতে ওর মনেও নানা চিন্তা দুলছিল। রঞ্জন বোসের কথাগুলো ওর কানে এখনও স্পষ্ট—“সত্যিটা হয়তো আপনার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।”
ট্রেনটা এগিয়ে চলেছে গ্রামবাংলার বুক চিরে। জানলা দিয়ে তাকিয়ে সে ভাবল, সত্যিই কি বিপদের দিকে এগোচ্ছে সে? নাকি এর পেছনে আছে অন্য কেউ, যে ইচ্ছাকৃতভাবে রহস্যটাকে ঘোলাটে করছে?
ট্রেন থেকে বোলপুর স্টেশনে নেমে একটা টোটো ধরে সোজা চলে গেল পূর্বপল্লীর গেস্টহাউসে। বিকেল তখন শেষের দিকে। ঘরে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে সে ঠিক করল, প্রথমেই অরুণিমার পুরনো বান্ধবী নন্দিতার সাথে দেখা করবে। নন্দিতা দত্ত, বিশ্বভারতীতে ইংরেজির প্রফেসর, অরুণিমার কলেজ জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
গেস্টহাউস থেকে বেরিয়ে রিকশা ধরে পৌঁছাল বিশ্বভারতীর কাছেই, শান্তিনিকেতনের এক ছোট্ট সুন্দর বাড়িতে। নন্দিতা আগেই ফোন পেয়েছিলেন, দরজা খুলে হাসিমুখে বললেন, “এসো সোহম, তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
বাড়ির ভেতর ঢুকে সোফায় বসতেই নন্দিতা সরাসরি বিষয়ে চলে এলেন, “অরুণিমার খবরটা শুনে আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। ও আত্মহত্যা করবে—এটা অসম্ভব!”
“আমারও ঠিক তাই মনে হচ্ছে,” সোহম বলল। “আমাকে একটু বলবেন, সম্প্রতি অরুণিমার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল?”
নন্দিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “হ্যাঁ, কয়েক মাস আগে অরুণিমা শান্তিনিকেতন এসেছিল। খুব অস্থির দেখাচ্ছিল ওকে। কিছু একটা ওকে খুব চিন্তায় ফেলেছিল।”
“কী বিষয়ে চিন্তা ছিল?” জানতে চাইল সোহম।
নন্দিতা ইতস্তত করে বললেন, “ওর সঙ্গে একজন ছিল, নাম বলেছিল সম্ভবত অভীক। অরুণিমার কলেজ জীবনের বন্ধু, কলকাতাতেই থাকে। ওদের মধ্যে বেশ গরমাগরম তর্কও দেখেছি একদিন। পরে ওর সাথে আলাদা কথা বলতে চাইলে অরুণিমা আমাকে এড়িয়ে যায়।”
“অভীক চ্যাটার্জী?” সোহম মনে মনে চমকে গেল। অভিনেতা অভীক চ্যাটার্জী, অরুণিমার সহ-অভিনেতা এবং দীর্ঘদিনের বন্ধু।
“হ্যাঁ, নামটা অভীক চ্যাটার্জীই হবে বোধহয়। ওরা খুব কাছের বন্ধু ছিল একসময়। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম সম্পর্কটা বদলে গেছে,” বললেন নন্দিতা।
“ওদের তর্কের বিষয়টা কী ছিল, মনে পড়ছে?” জানতে চাইল সোহম।
“বিষয়টা ঠিক বুঝিনি, তবে এতটুকু শুনেছিলাম—অরুণিমা অভীককে বলছিল, ‘আমি জানি তুই কী করতে চলেছিস, আমাকে থামাতে পারবি না।’ অভীক খুব রেগে গিয়েছিল কথাটা শুনে,” বললেন নন্দিতা।
“আর কিছু মনে পড়ছে?” সোহমের কণ্ঠে উত্তেজনা।
“একটা জিনিস অদ্ভুত লেগেছিল,” নন্দিতা একটু ভেবে নিয়ে বললেন, “ওরা যখন ঝগড়া করছিল, দূর থেকে দেখছিলাম অভীকের চোখ দুটো যেন অদ্ভুত নীল রঙের দেখাচ্ছিল। হয়তো আলো-ছায়ার জন্য। কিন্তু চোখগুলো অস্বাভাবিক ছিল, সেটুকু স্পষ্ট মনে আছে।”
সোহমের বুকটা ধক করে উঠল। আবারও সেই ‘নীলচোখ’!
নন্দিতা এবার উঠে ভেতরের ঘর থেকে ছোট একটা ডায়েরি এনে বললেন, “এটা অরুণিমার ডায়েরি, ও ভুল করে ফেলে গিয়েছিল। এর মধ্যে কিছু থাকতে পারে।”
সোহম ডায়েরিটা হাতে নিয়ে নন্দিতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল। মনে একটাই প্রশ্ন—অভীক চ্যাটার্জীর এই রহস্যময় আচরণের কারণ কী?
গেস্টহাউসে ফিরে ডায়েরি খুলল সে। প্রথম কয়েক পৃষ্ঠায় তেমন কিছুই নেই। কিন্তু শেষের পাতাগুলোতে লেখা অদ্ভুত কিছু লাইন—
“আমি জানি সত্যিটা সবাই মেনে নিতে পারবে না। অভীকও না। রঞ্জনও না। আর সবচেয়ে আশ্চর্য, দিদিও না। সত্যটা এত ভয়ঙ্কর যে, প্রকাশ্যে এলে অনেকের মুখোশ খুলে যাবে। আমাকে খুব সাবধান থাকতে হবে। বিশেষ করে সেই নীল চোখ থেকে, যে চোখের আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ংকর এক মুখ।”
সোহম ডায়েরিটা বন্ধ করল। সে নিশ্চিত হয়ে গেল, অরুণিমার মৃত্যুর রহস্যটা ওর ব্যক্তিগত জীবনেই লুকানো। এখানে সন্দেহের তালিকাটা ক্রমশ বাড়ছে—
রঞ্জন বোস—অর্থ ও ক্ষমতার অপব্যবহার, গোপন ব্যবসা
মঞ্জরী রায়—আর্থিক সুবিধা গ্রহণ
অভীক চ্যাটার্জী—অরুণিমার সঙ্গে অজ্ঞাত ঝামেলা
সোহিনী সেনগুপ্ত—অরুণিমার দিদি, পারিবারিক দ্বন্দ্ব
কিন্তু এই রহস্যময় “নীলচোখ”টা আসলে কে? এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
রাত গভীর। সোহম জানলায় চোখ রেখে দেখল, বাইরের আকাশে চাঁদটা যেন এক বড় রহস্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব এখন শুধু ওর।
অধ্যায় ৭: হাতিবাগানের পুরনো বাড়ি
শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় ফিরে আসার পর থেকেই সোহমের মাথায় নতুন নতুন প্রশ্নের জন্ম নিচ্ছিল। বিশেষ করে অরুণিমার ডায়েরির শেষ পাতার লেখা ওকে ভাবিয়ে তুলেছিল। “নীলচোখ” শব্দটা একটা বিপজ্জনক সংকেত—এটা ও বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু সেই রহস্যময় মুখটা কার? সেটা এখনও অজানা।
সোহম ঠিক করল, এবার সরাসরি কথা বলতে হবে অভীক চ্যাটার্জীর সঙ্গে। অভীকের ফোন নম্বর ওর কাছে ছিল না, তাই সে যোগাযোগ করল কাকা অরিন্দমের সাথে।
“অভীকের সঙ্গে দেখা করতে চাইছি কাকু,” সোহম ফোনে জানাল।
অরিন্দম বললেন, “দেখতে পারিস। তবে সাবধান থাকিস। অভীক কিন্তু মিডিয়ায় আগেই দাবি করেছে অরুণিমার মৃত্যুর সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। ও প্রভাবশালী অভিনেতা, দেখেশুনে কথা বলিস।”
সোহম বলল, “আমি জানি। তবে ডায়েরিটা অন্য কথা বলছে।”
পরদিন সকালে সোহম অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ে পৌঁছাল টালিগঞ্জে, অভীক চ্যাটার্জীর বিলাসবহুল বাড়িতে। দরজা খুলতেই দেখল অভীক সোফায় বসে অপেক্ষা করছেন। বেশ সুঠাম চেহারা, চেহারার গাম্ভীর্য চোখে পড়ার মতো।
“হ্যাঁ, বলুন। কী জানতে চান?” সরাসরি প্রশ্ন করলেন অভীক।
সোহম সরাসরি বলল, “শান্তিনিকেতনে আপনি অরুণিমার সঙ্গে তর্ক করেছিলেন। কী নিয়ে?”
অভীকের চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বললেন, “এটা তো ব্যক্তিগত ব্যাপার।”
সোহম বলল, “এখন আর ব্যক্তিগত নয়। কারণ অরুণিমার ডায়েরি বলছে, আপনার সঙ্গে তার সম্পর্কটা বেশ জটিল ছিল।”
অভীক এবার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, “দেখুন, আমি ওর বন্ধু ছিলাম। ওর মৃত্যুতে আমি শকড। আমাদের মধ্যে ঝগড়া হতেই পারে, কিন্তু এর সাথে ওর মৃত্যুর কী সম্পর্ক?”
সোহম ঠান্ডা গলায় বলল, “তাহলে বলুন, শান্তিনিকেতনে ঝগড়ার কারণটা কী?”
অভীক কিছুক্ষণ চুপ থেকে হালকা গলায় বললেন, “অরুণিমা আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বেশি নাক গলাচ্ছিল। আমার কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা আছে, সেটা নিয়ে ও কিছু বলেছিল। আমি রেগে গিয়েছিলাম। এর বেশি কিছু না।”
“সেদিন আপনার চোখে কোনো লেন্স ছিল?” সোহম সরাসরি প্রশ্ন করল।
অভীক ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “মানে? কী বলতে চাইছেন?”
“অরুণিমার মৃত্যুর আগের দিন ওঁর বাড়ির কাছে এক নীলচোখের মানুষকে দেখা গেছে। আপনার চোখেও নীল লেন্স ছিল বলে একজন সাক্ষী দাবি করেছেন।”
অভীক তীব্রভাবে প্রতিবাদ করলেন, “হাস্যকর! আমি কোনোদিন কন্টাক্ট লেন্স পরিনি! আপনি ভুল করছেন!”
সোহম শান্তভাবে বলল, “ঠিক আছে, আমি সেটা যাচাই করব।”
বেরিয়ে আসার সময় অভীক হঠাৎ বললেন, “শোনো, আমার একটা পরামর্শ আছে। হাতিবাগানে অরুণিমার একটা পুরনো বাড়ি আছে। ওখানে গেলে হয়তো কিছু জানতে পারবে। ওখানেই আমাদের অনেক স্মৃতি লুকানো আছে।”
সোহম কিছুটা অবাক হয়ে তাকাল। অভীক তাকে নিজেই সূত্র দিলেন? কেন?
পরদিন দুপুরেই সোহম পৌঁছে গেল উত্তর কলকাতার হাতিবাগানের সরু গলিতে। সেখানে পৌঁছে দেখল একটা প্রাচীন বাড়ি। বহুদিনের অব্যবহারে জীর্ণ বাড়ির দেওয়ালে লতাপাতার আস্তরণ। চারপাশে নিস্তব্ধতা, একটা রহস্যময় পরিবেশ।
বাড়িটার দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই দরজাটা কড়াৎ করে খুলে গেল। সোহম ভেতরে ঢুকল। ঘরের মধ্যে অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। চারদিকে তাকিয়ে হঠাৎ ওর নজরে পড়ল একটা পুরনো টেবিল। টেবিলের ওপর কিছু বই আর ফাইল ছড়ানো।
সোহম টেবিলের কাছে গেল, বইগুলোর মধ্যে একটা পুরনো ফাইল খুলতেই চমকে গেল। ফাইলের ভেতরে ছিল কিছু ছবি। একটি ছবিতে অরুণিমা, অভীক এবং আরও একজন অচেনা মানুষ। ছবিটা অনেক পুরনো, সম্ভবত পাঁচ-ছয় বছর আগের। লোকটার মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, তবে চোখ দুটো অদ্ভুতভাবে নীলচে। ছবির নিচে লেখা—”আমাদের প্রথম দেখা, শান্তিনিকেতন।”
সোহম মনোযোগ দিয়ে ফাইলটা দেখতে লাগল। ফাইলের ভেতর ছিল কিছু পুরনো চিঠিও। একটা চিঠিতে লেখা—
“তুমি জানো, তোমার সাথে সম্পর্কটা আমার জীবনটাকে কঠিন করে তুলছে। তোমার নীলচোখ দেখলেই আমার ভয় হয়। জানি না ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে। – অরুণিমা।”
সোহম নিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে গেল। তার মনে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠল—এই নীলচোখের রহস্যের শুরু শান্তিনিকেতনে, এবং সেখানেই আছে এর শেষও। কিন্তু এই রহস্যময় “নীলচোখ” আসলে কে?
ঠিক তখনই বাড়ির বাইরে থেকে কিছু একটা শব্দ শুনতে পেল সোহম। দরজার বাইরে কেউ কি ওকে অনুসরণ করছে?
সোহম সতর্ক হয়ে দাঁড়াল। বুঝতে পারল, বিপদটা আসলে অনেক কাছেই লুকিয়ে আছে।
অধ্যায় ৮: প্রভাবশালী মুখ
সোহম বাড়িটার ভেতরেই কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইল। দরজার বাইরে মৃদু একটা পায়ের শব্দ, যেন কেউ সাবধানে এগিয়ে আসছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য পুরো বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সোহম সতর্ক হয়ে নিজের ফোনের ক্যামেরা অন করে দরজার দিকে এগোল।
ধীরে ধীরে দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিল। সরু গলিটায় তখন কাউকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু কিছুক্ষণ আগেও যে কেউ ছিল সেটা ও স্পষ্ট টের পাচ্ছিল। সোহম চারপাশটা ভালো করে দেখে নিল। তখনই দেখল, সামনের রাস্তায় দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে এক যুবক। চেহারাটা অচেনা, তবে সন্দেহজনক।
সোহম দ্রুত গলিটা পেরিয়ে রাস্তায় নামল, কিন্তু ততক্ষণে সেই ছেলেটি ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে। কে ছিল? তাকে অনুসরণ করছিল কি?
হাতিবাগান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল সোহম। রহস্য ক্রমশ গভীর হচ্ছে। এই পুরনো বাড়ি থেকে পাওয়া ছবিটা এবং চিঠিটা বারবার ওর মনে একটা কথাই স্পষ্ট করছিল—অরুণিমার জীবনে এক রহস্যময় নীলচোখের ব্যক্তির ভূমিকা খুব গভীর ছিল।
সন্ধ্যার দিকে সোহম গেল কাকা অরিন্দম নন্দর অফিসে, কলকাতা পুলিশের হেডকোয়ার্টার, লালবাজারে। অরিন্দম ওকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, “এত সন্ধ্যায় এখানে কী করছিস?”
সোহম মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে বলল, “তোমার সাথে জরুরি কিছু কথা ছিল।”
অরিন্দম দরজা বন্ধ করে বললেন, “বস। কী হয়েছে?”
সোহম সরাসরি বলল, “কাকু, অরুণিমার মৃত্যুর তদন্তে আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। হাতিবাগানের পুরনো বাড়িতে একটা ছবি এবং কিছু চিঠি পেয়েছি। দেখো।”
অরিন্দম ছবি আর চিঠিগুলো হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন। ছবিটা দেখেই তার কপালে ভাঁজ পড়ল। তিনি বললেন, “এই লোকটাকে আগে দেখেছি মনে হচ্ছে।”
“কোথায় দেখেছ?” উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করল সোহম।
অরিন্দম কিছুটা চিন্তিত হয়ে বললেন, “কলকাতার একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, অতনু ঘোষাল। মিডিয়ায় মাঝে মাঝেই মুখ দেখায়। এই ছবির লোকটার চেহারাটা অনেকটাই তার মতো। তবে স্পষ্ট নয়।”
সোহম এবার মন দিয়ে বলল, “অতনু ঘোষাল! তার সাথে অরুণিমার কোনো যোগাযোগ ছিল?”
অরিন্দম ভ্রু কুঁচকে বললেন, “সরাসরি তো জানতাম না। তবে হ্যাঁ, কয়েক মাস আগে একটা মিডিয়া রিপোর্টে দেখেছিলাম, অতনু ঘোষালের বিরুদ্ধে অভিনেত্রী অরুণিমা সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ তীব্র কিছু মন্তব্য করেছিলেন। সেটা বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু পরে সব চাপা পড়ে যায়।”
“মানে, অরুণিমার সাথে অতনুর একটা শত্রুতামূলক সম্পর্ক ছিল,” সোহম একটু ভেবে বলল।
অরিন্দম গম্ভীর হয়ে বললেন, “হ্যাঁ। তবে অতনু ঘোষাল সহজ নয়। তার রাজনৈতিক ক্ষমতা অনেক। ওর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করলেই ওপর থেকে চাপ আসতে পারে।”
সোহম আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, “চাপ এলেও সত্যটা আমাদের সামনে আনতেই হবে। আরেকটা ব্যাপার, আজ হাতিবাগানে আমাকে কেউ অনুসরণ করছিল।”
“কি বলছিস?” অরিন্দম কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন, “কে হতে পারে?”
“জানি না। তবে মনে হচ্ছে কেউ এই তদন্ত থেকে আমাকে দূরে রাখতে চাইছে। অরুণিমার ডায়েরিতেও লেখা ছিল, অনেক মুখোশ খুলে যাবে। সম্ভবত সেই মুখোশের আড়ালেই আছে এই রাজনৈতিক মুখগুলো,” বলল সোহম।
অরিন্দম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “ঠিক আছে, সাবধানে থাকবি। অতনুর ব্যাপারটা আমি অফিসিয়ালি খোঁজ নিচ্ছি। তুই বরং অন্য সূত্রগুলো আরো গভীরে দেখ।”
সোহম সায় দিল। কিন্তু ওর মন বলছিল, এই তদন্ত এবার একটা নতুন মাত্রায় পৌঁছে গেছে। রঞ্জন বোস, অভীক চ্যাটার্জী, এবং এবার অতনু ঘোষাল—কলকাতার ক্ষমতার কেন্দ্রের তিনটি মুখ এই রহস্যের জালে জড়িয়ে গেছে। কিন্তু সবার আড়ালে সেই ‘নীলচোখ’—যার আসল পরিচয় এখনও অধরা।
অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবল সোহম। রাতের কলকাতা আজ যেন একটু বেশি রহস্যময়। অন্ধকারের মাঝে, আলো-আঁধারির খেলায় লুকিয়ে আছে এমন কিছু সত্য, যা ওর জীবনটাকেও বদলে দিতে পারে।
বাইরে রাতটা আরও গভীর হচ্ছে। শহরটা ঘুমিয়ে গেলেও, সোহমের ভেতরে জেগে আছে সত্যের সন্ধানের তীব্র আলো। সামনে যে সত্য অপেক্ষা করছে, তার মুখোমুখি হতে সে প্রস্তুত তো?
অধ্যায় ৯: প্রত্যক্ষদর্শীর ভয়ানক বয়ান
পরদিন সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা। কলকাতার ব্যস্ত রাস্তাগুলো যেন কেমন ভারি হয়ে আছে। কিন্তু সোহমের মাথার ভেতরে চিন্তার ভারটা আকাশের থেকেও ভারি। গত কয়েকদিনের ঘটনাগুলো তাকে আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সন্দেহের তালিকায় প্রভাবশালী সব মুখ—রঞ্জন বোস, অভীক চ্যাটার্জী, অতনু ঘোষাল, সবার মুখই স্পষ্ট, কিন্তু আসল অপরাধীর মুখটা এখনো ধোঁয়াশায়।
সোহম ঠিক করল আরেকবার “আইভি রেসিডেন্সি”-তে যাবে। অভিনেত্রীর ফ্ল্যাটের সেই নিরাপত্তারক্ষী সুধীর সরকারের সঙ্গে তার আলাদা করে কথা বলা দরকার। কারণ সুধীরই একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী, যিনি সেই রাতে রহস্যময় “নীলচোখ”-কে দেখেছেন।
বেলা এগারোটার দিকে সে পৌঁছাল আইভি রেসিডেন্সির নিচে। গেটে দাঁড়ানো নিরাপত্তারক্ষীকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানাল, “সুধীরদা ভেতরেই আছেন। রাতের শিফটে ছিলেন, একটু ক্লান্ত।”
সোহম ভেতরে ঢুকে দেখল, সুধীর গার্ডরুমে বসে একটা চেয়ারে ঢুলছেন। ওকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “হ্যাঁ, বলুন স্যার, কিছু জানতে চান?”
সোহম সরাসরি বলল, “সুধীরবাবু, আপনি ওই রাতে একটা নীলচোখের মানুষকে দেখেছিলেন। একটু বিস্তারিতভাবে বলুন তো।”
সুধীর কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে ইতস্তত করে বললেন, “স্যার, ব্যাপারটা অনেকেই বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখেছি।”
“কী দেখেছিলেন?” মনোযোগী হয়ে উঠল সোহম।
সুধীর গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলেন, “রাত তখন প্রায় আটটা। আমি নিচে ডিউটিতে ছিলাম। হঠাৎ দেখি, আমাদের বিল্ডিংয়ের ভেতর দিয়ে দ্রুত একজন সিঁড়ির দিকে যাচ্ছেন। লোকটার মাথায় হুডি দেওয়া ছিল, মুখ স্পষ্ট দেখতে পাইনি, কিন্তু যখন পাশ দিয়ে গেল, মুহূর্তের জন্য তার মুখের দিকে চোখ পড়তেই আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।”
“কেন?” সোহম জানতে চাইল।
“লোকটার চোখ দুটো ছিল অদ্ভুত নীলাভ, অন্ধকারেও যেন আলো জ্বলছিল। একেবারে অস্বাভাবিক, কৃত্রিম নীল,” সুধীর বললেন।
“আপনি তাকে আটকাননি?” জিজ্ঞেস করল সোহম।
“স্যার, আমি আটকালেও সে খুব দ্রুত চলে যায়। ভেবেছিলাম ম্যাডামের কোনো পরিচিত। কিন্তু আধ ঘণ্টার মধ্যেই শুনলাম ম্যাডাম মারা গেছেন। আমার বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল,” সুধীর কাঁপা গলায় বললেন।
“সেদিন সন্ধ্যায় আর কাউকে দেখেছিলেন?” আবার জিজ্ঞেস করল সোহম।
সুধীর কিছুটা ভেবে বললেন, “হ্যাঁ স্যার। সন্ধ্যা সাতটার একটু পরে ম্যাডামের বড় বোন সোহিনী সেনগুপ্ত এসেছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ থেকে বেরিয়ে যান। তবে ওনাকে এর আগেও অনেকবার দেখেছি, তাই সন্দেহ করিনি।”
“সোহিনী সেনগুপ্ত?” সোহম অবাক হয়ে গেল।
“হ্যাঁ স্যার। ম্যাডামের সাথে উনার সেদিন কথাবার্তায় বেশ উত্তেজনা ছিল। বেরোনোর সময়ও উনার মুখ খুব রেগে ছিল,” বললেন সুধীর।
সোহম মনে মনে ব্যাপারটা নোট করে নিল। সোহিনী সেনগুপ্তের এই নতুন তথ্যটা আরও একটা সন্দেহের পথ খুলে দিল। পারিবারিক অশান্তির ব্যাপারটা স্পষ্ট হলো।
সুধীর এবার হঠাৎ গলা নামিয়ে বললেন, “আরেকটা ব্যাপার স্যার। ওই নীলচোখের লোকটার হাতে একটা ছোট্ট কালো ব্যাগ ছিল। ব্যাগটা দেখতে অদ্ভুত ছিল, যেন মেডিকেল ব্যাগ।”
সোহম চমকে উঠল, “মেডিকেল ব্যাগ?”
“হ্যাঁ স্যার। আমি নিশ্চিত, এটা মেডিকেল ব্যাগই ছিল,” বললেন সুধীর।
সোহম এবার পুরো ঘটনাটা মনে মনে আবার সাজিয়ে নিল। একজন নীলচোখের মানুষ, মেডিকেল ব্যাগ, অদ্ভুত ওষুধের প্রভাব—সব মিলিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার। এটা একটা পরিকল্পিত খুন। সম্ভবত টক্সিন বা বিষাক্ত রাসায়নিক দিয়ে হত্যা।
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ,” বলে বেরিয়ে এল সোহম। সুধীরের এই সাক্ষ্য মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হতে পারে।
রাস্তায় নেমে দাঁড়িয়ে ফোনটা বের করল সে। কাকা অরিন্দমকে ফোন করতেই বললেন, “কিছু পেলি?”
সোহম বলল, “অনেক কিছু। প্রথমত, এটা নিশ্চিত যে এটা খুন। দ্বিতীয়ত, অপরাধী সম্ভবত মেডিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডের। তৃতীয়ত, অভিনেত্রীর দিদি সোহিনী সেনগুপ্তর গতিবিধি সন্দেহজনক।”
“খুব ভালো,” অরিন্দম বললেন, “সোহিনীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।”
“হ্যাঁ, কাকু। আর সেই নীলচোখের ব্যক্তিও মেডিকেল লাইনেই হতে পারে। তদন্তটা এবার মেডিকেল অ্যাঙ্গেলে এগোতে হবে,” বলল সোহম।
অরিন্দম ফোন রেখে দিলেন। সোহম জানত, এবার তাকে আরও গভীরভাবে, আরো বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে তদন্ত করতে হবে। সন্দেহভাজন তালিকা বাড়লেও আসল অপরাধীর চেহারা এখনও অধরা।
সন্ধ্যার কলকাতায় পা বাড়িয়ে সে বুঝতে পারছিল, এই তদন্তের শেষ পর্বটা ওর জন্য অনেক বেশি জটিল আর বিপজ্জনক হয়ে উঠতে চলেছে। কিন্তু সত্যটা সামনে আনতে তাকে এগোতেই হবে।
অধ্যায় ১০: শান্তিনিকেতনের হারিয়ে যাওয়া অতীত
সোহম বুঝতে পারছিল, এই রহস্যের গভীরে পৌঁছতে হলে অরুণিমার অতীতের ধুলো সরানো দরকার। বিশেষ করে, শান্তিনিকেতনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। আগেরবার অল্প সময়ের জন্য গিয়েছিল বলে সবটা স্পষ্ট বোঝা যায়নি। এবার ঠিক করল, আরও গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করবে।
পরদিন সকালে সে আবার ট্রেন ধরল শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে। ট্রেনের জানলার পাশে বসে ও ভাবছিল, অরুণিমার সেই রহস্যময় ডায়েরি এবং হাতিবাগানের বাড়ির ছবি ও চিঠিগুলো এই জটিল কেসের মোড়টাই বদলে দিয়েছে।
শান্তিনিকেতনে পৌঁছে প্রথমেই সে নন্দিতা দত্তর বাড়িতে গেল। নন্দিতা আবার ওকে দেখে বেশ অবাক হলেন।
“আবার এসেছো? কী ব্যাপার?” নন্দিতা উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
“আপনাকে আরও কিছু প্রশ্ন করার ছিল। অরুণিমার অতীত জীবন নিয়ে,” সোহম সরাসরি বলল।
নন্দিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “ঠিক আছে। তবে এবারে একটু ভেতরের ঘরে এসো। তোমাকে একটা জিনিস দেখানো দরকার।”
সোহম ভেতরে ঢুকে দেখল, ঘরের একপাশে পুরনো একটা কাঠের আলমারি। নন্দিতা সেটার তালা খুলে ভেতর থেকে একটা ছোট কাঠের বাক্স বের করলেন। বাক্স খুলে বেরোল কয়েকটা পুরনো ফটো আর একটা চিঠি।
সোহম মনোযোগ দিয়ে ছবিগুলো দেখতে লাগল। ছবিতে রয়েছে অরুণিমা, অভীক এবং সেই রহস্যময় ব্যক্তি। এবার ছবিটা স্পষ্ট। লোকটা বেশ স্মার্ট, দেখতে ভদ্র, চোখ দুটো অস্বাভাবিক নীলাভ।
“এই লোকটা কে?” সোহম উত্তেজিত গলায় জানতে চাইল।
নন্দিতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “নামটা ঠিক মনে নেই, কিন্তু ছেলেটা মেডিকেলের ছাত্র ছিল। সম্ভবত কলকাতার কোনো মেডিকেল কলেজের। অরুণিমা আর ওই ছেলেটার মধ্যে সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল।”
“মেডিকেলের ছাত্র?” সোহম চমকে উঠল। সুধীরের বলা মেডিকেল ব্যাগের কথা মনে পড়ে গেল। “আপনি একটু ভেবে দেখুন তো, নামটা মনে পড়ে?”
নন্দিতা গভীরভাবে চিন্তা করে বললেন, “সম্ভবত নামটা ‘নীলাদ্রি’ বা এমন কিছু একটা ছিল। হ্যাঁ, নীলাদ্রি চৌধুরী।”
“নীলাদ্রি চৌধুরী,” নামটা বারবার মনে মনে আওড়াল সোহম। “এখন কোথায় থাকে, জানেন?”
“জানি না। কিন্তু শুনেছিলাম ওর সাথে অরুণিমার বড় ঝামেলা হয়েছিল। তারপর থেকেই অরুণিমা নীলাদ্রির নাম পর্যন্ত মুখে আনত না,” বললেন নন্দিতা।
“কী ঝামেলা হয়েছিল?” জিজ্ঞেস করল সোহম।
নন্দিতা বললেন, “অরুণিমা নাকি একবার বলেছিল, নীলাদ্রি অদ্ভুত কিছু ওষুধ বা ড্রাগ নিয়ে গবেষণা করত। ও নাকি হিপনোটিক ড্রাগ নিয়ে অদ্ভুত সব পরীক্ষা চালাত। এই নিয়ে তাদের ঝগড়া হয়। তারপর বিচ্ছেদ। অরুণিমা খুব ভয় পেয়েছিল ওকে নিয়ে।”
“হিপনোটিক ড্রাগ?” সোহমের কপালে ভাঁজ পড়ল। অরুণিমার মৃত্যুর সময় পাওয়া অজানা টক্সিনের কথা মনে পড়ে গেল।
নন্দিতা এবার বাক্স থেকে একটা চিঠি বের করে বললেন, “এটা পড়ো। এটা সেই নীলাদ্রির লেখা, অরুণিমাকে।”
সোহম চিঠিটা পড়তে শুরু করল—
“অরু,
তুমি আমার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিলে। তোমার চোখে আমি প্রথম দেখেছিলাম সফলতার নীল আলো। কিন্তু তুমি আমাকে ভুল বুঝলে। একদিন তোমার চোখের সামনে ঠিক ফিরে আসব, অন্য এক রূপ নিয়ে।
– নীল”
চিঠিটা পড়ে সোহমের গলা শুকিয়ে গেল। “চোখের সামনে ফিরে আসব, অন্য এক রূপ নিয়ে…”—নীলচোখের সেই রহস্যময় সংকেতটা এবার পরিষ্কার।
নন্দিতা কাঁপা গলায় বললেন, “আমি কখনো ভাবিনি নীলাদ্রির এই কথাগুলো এভাবে সত্যি হয়ে যাবে।”
সোহম এবার বলল, “অরুণিমা সম্ভবত নীলাদ্রিকেই সেই রাতে দেখেছিল। ওকে চিনতে পারেনি, কারণ নীলাদ্রি হয়তো সত্যিই তার রূপ বদলেছে। আর সেটাই ওর জীবনের শেষ মুহূর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল।”
“এখন কী করবে?” উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন নন্দিতা।
“কলকাতায় ফিরে নীলাদ্রি চৌধুরীকে খুঁজে বার করব। তার মেডিকেল ব্যাকগ্রাউন্ড এবং ওই বিশেষ হিপনোটিক ড্রাগের ব্যাপারটা তদন্তের মোড়টাই পাল্টে দিতে পারে,” দৃঢ় কণ্ঠে বলল সোহম।
ফেরার পথে ট্রেনে বসে সোহম জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারছিল, রহস্যের এই অধ্যায়ে সে এখন আরও বড় বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে। কারণ, যে সত্য তার সামনে আসছে, সেটাকে রুখতে নীলচোখের মানুষটা যে কোনো কিছু করতে পারে।
ট্রেনটা কলকাতার দিকে এগোচ্ছে, আর সোহম বুঝতে পারছে—এখন আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই। সত্যটা সামনে আনতেই হবে, যে কোনো মূল্যে।
অধ্যায় ১১: পরিবারের ছায়ায় রহস্য
কলকাতায় ফিরে আসার পর সোহমের মাথায় একটা কথা বারবার ঘুরতে লাগল—অভিনেত্রীর দিদি সোহিনী সেনগুপ্ত। তাঁর আচরণে এমন কী ছিল যে, অরুণিমা নিজের ডায়েরিতে তাঁর কথাও উল্লেখ করেছিলেন? এবং অভিনেত্রীর মৃত্যুর সন্ধ্যায় তাঁর উপস্থিতি রহস্যজনক মনে হচ্ছিল।
পরদিন সকালেই সোহম ঠিকানা নিয়ে পৌঁছে গেল দক্ষিণ কলকাতার একটি অভিজাত আবাসনে, যেখানে সোহিনী সেনগুপ্ত থাকেন। বেল টিপতেই দরজা খুললেন বছর চল্লিশের একজন মহিলা। মুখের গড়নে অরুণিমার সঙ্গে কিছুটা মিল থাকলেও চোখে-মুখে একটা কঠিন ছাপ।
“আপনিই সোহিনী সেনগুপ্ত?” সোহম সরাসরি প্রশ্ন করল।
“হ্যাঁ। আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না,” সোহিনী সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললেন।
“আমি সোহম নন্দ। অরুণিমার মৃত্যুর তদন্ত করছি,” সোহম শান্ত গলায় পরিচয় দিল।
সোহিনী কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করেই দরজা খুলে বললেন, “ভেতরে আসুন।”
সোহম ঘরে ঢুকে চারপাশটা ভালো করে দেখল। দামি আসবাব, দেয়ালে বিখ্যাত পেইন্টিং—বিলাসের ছাপ স্পষ্ট। বসার ঘরে বসে সরাসরি প্রশ্ন করল, “আপনার বোনের মৃত্যুর দিন আপনি ওর বাড়িতে গিয়েছিলেন কেন?”
সোহিনী একটু থমকে গিয়ে সামলে নিয়ে বললেন, “আমাদের পারিবারিক কিছু আলোচনা ছিল। ওর সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে সামান্য মতানৈক্য হয়েছিল। তবে ওটা খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার।”
“ব্যক্তিগত থাকছে না, যখন সেই সন্ধ্যাতেই তার মৃত্যু হয়। আপনারা দুজনেই উত্তেজিত ছিলেন, এটা ঠিক?” সোহম তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল।
সোহিনী চোখ সরিয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন, “হ্যাঁ, উত্তেজনা ছিল। অরুণিমা তার প্রপার্টি থেকে আমাকে বঞ্চিত করতে চাইছিল। আমি জানতে গিয়েছিলাম কেন ও এমন করছে। কিন্তু আমি কোনো ক্ষতি করিনি ওর। ও আমার বোন ছিল।”
“কিন্তু অরুণিমার ডায়েরিতে অন্য কথাও আছে,” সোহম একটু থেমে বলল। “ও লিখেছে, আপনি ওর সত্যিটা মেনে নিতে পারবেন না। সেটা কী সত্য?”
সোহিনী যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন। তারপর অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললেন, “আমি সত্যি জানি না। তবে অরুণিমা সম্প্রতি অদ্ভুত আচরণ করছিল। ও বলেছিল, আমাদের পরিবারে একজন বিপজ্জনক মানুষ আছে। আমি তখন গুরুত্ব দিইনি।”
সোহমের চোখ এবার তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল, “কে সেই বিপজ্জনক মানুষ?”
সোহিনী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “আমাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়, নীলাদ্রি চৌধুরী। সে মেডিকেলের ছাত্র ছিল, কলকাতায় বড় হয়েছে। ওদের মধ্যে একটা পুরনো ঝামেলা ছিল।”
সোহম এবার উত্তেজিত হয়ে বলল, “নীলাদ্রি আপনাদের আত্মীয়? এটা আগে বলেননি কেন?”
সোহিনী হালকা ভয় পেয়ে বললেন, “নীলাদ্রি বহুদিন আমাদের সংস্পর্শে নেই। অরুণিমাই সবসময় ওকে নিয়ে চিন্তিত থাকত। আমি ওকে গুরুত্ব দিইনি।”
সোহম এবার মাথায় সবটা সাজিয়ে নিল। নীলাদ্রি শুধু মেডিকেলের ছাত্রই নয়, সে অরুণিমার আত্মীয়ও। অর্থাৎ ওর উপস্থিতি কখনোই সন্দেহের উদ্রেক করত না। এটাই হয়তো ছিল তার মূল সুবিধা।
সোহিনী হঠাৎ নরম স্বরে বললেন, “আপনাকে একটা কথা বলব?”
“বলুন,” সোহম উৎসাহ নিয়ে বলল।
“আমার মনে হয় অরুণিমার মৃত্যুটা শুধু অর্থের জন্য নয়। এর পেছনে বড় কিছু লুকিয়ে আছে। অরুণিমা আমাকে একবার বলেছিল, সে এমন কিছু জানে, যা প্রকাশ হলে কলকাতার কয়েকজন ক্ষমতাবান মানুষ খুব বিপদে পড়বে।”
“কারা?” সোহম দ্রুত প্রশ্ন করল।
“ঠিক জানি না। তবে রঞ্জন বোস আর অতনু ঘোষালের নাম ওর মুখে শুনেছিলাম। আর অভীককেও সে বিশ্বাস করত না।”
সোহম এবার বুঝতে পারল, পরিবারের ছায়াতেও রহস্যটা এতদিন চাপা পড়েছিল। অরুণিমার জীবনে অনেকগুলো মুখোশ পরা মানুষ ছিল। কিন্তু আসল অপরাধী কে—সেটাই এখন খুঁজে বের করতে হবে।
সোহিনী হঠাৎ অসহায় গলায় বললেন, “সত্যিটা কী জানি না, কিন্তু আমি আমার বোনকে হারিয়েছি। সত্যিটা আপনি বের করুন, প্লিজ।”
সোহম উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি সেটাই করার চেষ্টা করছি। আর একটা কথা, আপনিও সাবধানে থাকবেন। আপনার বোনের সাথে যা হয়েছে, তা অন্যদের সাথেও হতে পারে।”
বেরিয়ে আসার সময় সোহম নিশ্চিত হয়ে গেল, এই রহস্যের শেষটা খুব কাছে। কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে গেলে ওকে যে আরও বড় বিপদের মুখোমুখি হতে হবে, সেটা ও বুঝে গিয়েছিল।
রাস্তায় নেমে দাঁড়িয়ে সোহম দেখল, আকাশে কালো মেঘ জমছে। কলকাতার হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে রহস্যের গন্ধ। “নীলচোখ”-এর আসল পরিচয় সামনে আনার সময় হয়ে এসেছে।
অধ্যায় ১২: চূড়ান্ত বিশ্লেষণ—অপ্রত্যাশিত মোড়
সোহিনী সেনগুপ্তের সাথে কথা বলে বেরিয়ে আসার পর থেকে সোহমের মনের মধ্যে একটাই কথা বারবার ঘুরছিল—”নীলাদ্রি চৌধুরী।” এই নামটা যে কেসের সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি হয়ে উঠতে চলেছে, সেটা ও এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছিল।
সোহম এবার আর বিলম্ব না করে সরাসরি গেল কাকা অরিন্দম নন্দর অফিসে, লালবাজার। দরজা খুলতেই অরিন্দম ওকে দেখে বললেন, “তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু বড় তথ্য পেয়েছিস?”
সোহম গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “কাকু, রহস্যের সমাধানটা হয়তো খুব কাছে। নীলাদ্রি চৌধুরী নামের লোকটাকে খুঁজতে হবে।”
“নীলাদ্রি?” অরিন্দম চিন্তিত হয়ে বললেন, “তুই নিশ্চিত?”
“একেবারে নিশ্চিত,” সোহম দৃঢ়তার সাথে বলল। “ও শুধু মেডিকেলের ছাত্রই ছিল না, অভিনেত্রীর দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও। ওর পক্ষে সহজ ছিল অভিনেত্রীর কাছে যাওয়া।”
অরিন্দম দ্রুত অফিসের কম্পিউটার থেকে নামটা সার্চ করলেন। পুলিশের ডাটাবেস থেকে নীলাদ্রির পুরো ইতিহাস বেরিয়ে এল। সোহমও স্ক্রিনে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল—
নীলাদ্রি চৌধুরী:
কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্র
নিউরোলজি ও সাইকিয়াট্রি নিয়ে গবেষণার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত
বেশ কয়েক বছর আগে সন্দেহজনক ওষুধ নিয়ে গবেষণার কারণে মেডিকেল কলেজ থেকে বহিষ্কৃত
বর্তমানে উত্তর কলকাতায় নিজস্ব একটি ক্লিনিক পরিচালনা করেন
“ব্যস, পাওয়া গেছে!” অরিন্দম উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
সোহম বলল, “কাকু, এক্ষুনি নীলাদ্রির সঙ্গে কথা বলা দরকার।”
এক ঘণ্টার মধ্যেই সোহম ও অরিন্দম পৌঁছে গেল উত্তর কলকাতার সেই ক্লিনিকে। বাইরে থেকে বাড়িটা বেশ পুরনো, ভেতরে ঢুকতেই অস্বস্তিকর একটা পরিবেশ টের পাওয়া গেল। ছোট্ট রিসেপশন ডেস্কে বসা একজন মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?”
অরিন্দম পুলিশ আইডি দেখিয়ে বললেন, “নীলাদ্রি চৌধুরীর সাথে দেখা করতে এসেছি। জরুরি কাজ।”
মহিলাটি কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও ভেতরে একটা কল দিলেন। কিছুক্ষণ পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন প্রায় চল্লিশ বছর বয়সী একজন মানুষ। মুখে হালকা দাড়ি, চোখে চশমা, চেহারায় বুদ্ধিদীপ্ত ছাপ।
“হ্যাঁ, আমি নীলাদ্রি চৌধুরী। কী ব্যাপার?” লোকটি ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন।
সোহম ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকাল। চোখের মণি দুটো অদ্ভুতভাবে তীক্ষ্ণ, আর রঙটা যেন কিছুটা কৃত্রিম।
“অভিনেত্রী অরুণিমা সেনগুপ্তের মৃত্যুর তদন্ত করছি। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই,” সোহম সরাসরি বলল।
নীলাদ্রির মুখটা মুহূর্তেই বদলে গেল। কিছুটা সামলে নিয়ে ঠান্ডা হেসে বললেন, “নিশ্চয়ই, আসুন আমার ঘরে।”
ঘরে ঢুকতেই ওরা দেখল, টেবিলের ওপর বেশ কিছু মেডিকেল বই এবং ছোট ছোট কাচের বোতল রাখা। দেয়ালে ঝুলছে নিউরোলজি আর মস্তিষ্কের ম্যাপ।
সোহম প্রশ্ন করল, “আপনি হিপনোটিক ড্রাগ নিয়ে গবেষণা করেন?”
নীলাদ্রি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন, “হ্যাঁ। আমার গবেষণা নিউরোলজি এবং মানুষের মনের ওপর। এতে অন্যায় কিছু নেই।”
“অরুণিমা সেনগুপ্তের মৃত্যুর দিন সন্ধ্যায় আপনি কোথায় ছিলেন?” এবার প্রশ্ন করলেন অরিন্দম।
নীলাদ্রি স্মিত হেসে বললেন, “আমার ক্লিনিকেই ছিলাম। চেম্বারে রোগী দেখছিলাম।”
“আপনার কাছে কি তার প্রমাণ আছে?” প্রশ্ন করল সোহম।
নীলাদ্রি হেসে ফোন বের করে একটা সিসিটিভি ফুটেজ দেখিয়ে বললেন, “আপনারা নিশ্চিন্তে দেখতে পারেন। ওই সময় আমি এখানেই ছিলাম।”
সোহম কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ল। নীলাদ্রি হাসলেন, “আপনারা কি আমাকে সন্দেহ করছেন? অরুণিমার সঙ্গে আমার অনেকদিন দেখা নেই। ওর মৃত্যুর খবর আমিও শুনেছি। কিন্তু কেন আমাকে সন্দেহ করছেন?”
সোহম এবার টেবিলে থাকা ছোট একটা কাচের বোতলের দিকে আঙুল তুলে বলল, “এটা কী ওষুধ?”
নীলাদ্রি একটু বিচলিত হয়ে বললেন, “সাধারণ নিউরোলজিকাল সিডেটিভ। ঘুম আনতে সাহায্য করে।”
“এটা হিপনোটিক ড্রাগ?” সোহম সরাসরি প্রশ্ন করল।
নীলাদ্রি এবার চোখে হালকা অস্বস্তি নিয়ে বললেন, “হ্যাঁ। কিন্তু আমি তো গবেষক। ওষুধ তৈরি করতেই পারি।”
সোহম এবার দৃঢ় গলায় বলল, “অরুণিমার শরীরে আপনার তৈরি বিশেষ হিপনোটিক ড্রাগের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?”
নীলাদ্রি মুহূর্তেই কেঁপে উঠলেন। চোখে ভয় ও বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন সোহমের দিকে। এবার যেন তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি ফাঁদে পড়েছেন।
“আমি…আমি সত্যিই ওকে মারতে চাইনি। কিন্তু…” নীলাদ্রি থেমে গেলেন।
“কিন্তু কী?” সোহম গর্জে উঠল।
নীলাদ্রি কাঁপা গলায় বললেন, “আমি শুধু ওকে থামাতে চেয়েছিলাম। ও আমার গোপন তথ্য প্রকাশ করতে চাইছিল। কিন্তু আমি ওকে হত্যা করিনি! বিশ্বাস করুন…”
সোহম এবার সত্যিটা স্পষ্ট দেখতে পেল। অপরাধী সত্যিই নীলাদ্রি নয়। কিন্তু তাহলে কে?
এই অপ্রত্যাশিত মোড়ে সোহম এবার নতুন করে ভাবতে বাধ্য হলো—আসল অপরাধী এমন একজন, যাকে সে এখনও সন্দেহ করেনি। সেই মুখটা এবার ওর সামনে আনতেই হবে।
অধ্যায় ১৩ : শেষ সূত্রের খোঁজে
সোহম নিজের ঘরে ফিরে এল, মাথায় অস্থিরতার ঝড়। এতগুলো চরিত্র, এতগুলো সূত্র, অথচ পুরো ছবিটা এখনও অস্পষ্ট। অরুণিমার মৃত্যুর তদন্তে প্রতিটা মানুষের ভূমিকা নিয়ে সে আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করল।
নোটবুকটা খুলে প্রতিটা তথ্য নতুন করে লিখতে শুরু করল সে:
অভিনেত্রীর ঘরে পাওয়া নীল কন্টাক্ট লেন্স।
সিকিউরিটি গার্ডের দেখা সেই অদ্ভুত নীলচোখের ব্যক্তি।
নীলাদ্রি চৌধুরীর তৈরি বিশেষ হিপনোটিক ড্রাগ।
অরুণিমার ডায়েরির লেখা।
সবকিছু মিলিয়ে এই মুহূর্তে মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নীলাদ্রি চৌধুরী। কিন্তু সোহমের মন বলছিল, নীলাদ্রি এই রহস্যের মূল নয়। কারণ নীলাদ্রি সরাসরি হত্যার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না, সিসিটিভি ফুটেজেই তার প্রমাণ মিলেছে।
তাহলে খুন করেছে কে? সোহমের মাথায় একটা জিনিস স্পষ্ট—অরুণিমা এমন একজনের কাছ থেকেই ওষুধ নিয়েছিল যাকে সে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করত।
এই বিশ্বাসের তালিকায় কে কে থাকতে পারে?
মঞ্জরী রায়—সন্দেহজনক, তবে অরুণিমা তাকে খুব বেশি বিশ্বাস করত না।
রঞ্জন বোস—সম্পর্ক ছিল, কিন্তু সম্প্রতি বিচ্ছেদ, তাই বিশ্বাস প্রশ্নবিদ্ধ।
অভীক চ্যাটার্জী—পুরনো বন্ধু, কিন্তু দ্বন্দ্ব ছিল।
সোহিনী সেনগুপ্ত—সম্পত্তির দ্বন্দ্ব ছিল, বিশ্বাসে ভাঙন ছিল।
অঙ্কিত বসু—দীর্ঘদিনের ম্যানেজার ও বিশ্বস্ত বন্ধু।
সোহম চোখ বন্ধ করে ভাবল। এই পাঁচজনের মধ্যে অঙ্কিত বসুই একমাত্র মানুষ, যার প্রতি অরুণিমার বিশ্বাস প্রশ্নাতীত ছিল। কিন্তু অঙ্কিত কেনই বা খুন করতে যাবে? অঙ্কিতের কোনো ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
হঠাৎ সোহমের মাথায় একটা সম্ভাবনা খেলে গেল। সে দ্রুত ফোনটা তুলে নিল। এবার ফোন করল নিজের ছোট ভাই শুভ্রকে।
“হ্যাঁ, দাদা, বল,” শুভ্র দ্রুত বলল।
“শুভ্র, তুই একটা কাজ কর। সোশ্যাল মিডিয়া আর অনলাইন নিউজে অঙ্কিত বসু সম্পর্কে যত খবর পাবি, সব আমাকে পাঠা। বিশেষ করে গত তিন মাসের ভেতরে অঙ্কিতের ব্যক্তিগত জীবনে কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কি না, খোঁজ নে,” সোহম উত্তেজিত হয়ে বলল।
“আমি এখনই দেখছি,” শুভ্র রাজি হয়ে ফোন রাখল।
ঘণ্টাখানেক পরেই শুভ্র ফোন করল। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, “দাদা, একটা জিনিস পেয়েছি। গত কয়েক মাস ধরে অঙ্কিত বসু অদ্ভুতভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ইনঅ্যাকটিভ ছিল। অথচ তার আগে সে খুব নিয়মিত পোস্ট করত।”
“অদ্ভুত কেন?” সোহম ভাবতে লাগল।
“আরও একটা জিনিস, তিন মাস আগে অঙ্কিত বসু বিদেশে গিয়েছিল, সিঙ্গাপুর। ফিরে আসার পর থেকেই তার আচরণে পরিবর্তন আসে বলে একটা পোস্টে লেখা ছিল,” শুভ্র যোগ করল।
“সিঙ্গাপুর? কী করছিল ওখানে?” সোহম নিজের মনেই বলল। “ঠিক আছে, শুভ্র। পরে কথা বলছি।”
ফোনটা রেখে সোহম আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসল। দ্রুত সে সিঙ্গাপুরের মেডিকেল ইনস্টিটিউট, বিশেষত নিউরোলজি ও হিপনোটিক ড্রাগের উপর রিসার্চ সেন্টারগুলো নিয়ে সার্চ করতে লাগল। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর সে অবাক হয়ে দেখল, সিঙ্গাপুরে একটি হাই-টেক নিউরো-ল্যাব রয়েছে, যেখানে সম্প্রতি একটি বিশেষ হিপনোটিক ড্রাগ তৈরি হয়েছে। ড্রাগটির বৈশিষ্ট্য হলো, এটি সেবন করলে মৃত্যুর আগে পর্যন্তও শরীরে প্রায় কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ বোঝা যায় না।
সোহম থমকে গেল। তাহলে কি অঙ্কিত সিঙ্গাপুর থেকে এই ড্রাগ সংগ্রহ করে এনেছিল?
তবে শুধু অনুমানে হবে না, তার প্রমাণ দরকার। প্রমাণ জোগাড় করার জন্য অঙ্কিতের ফোনের লোকেশন ও কল ডিটেইলস দরকার। সোহম দ্রুত ফোন করল কাকা অরিন্দমকে।
“হ্যাঁ সোহম, বল,” অরিন্দম বললেন।
“কাকু, অঙ্কিত বসুর কল রেকর্ড এবং লোকেশন ট্র্যাক করতে পারবে গত কয়েক সপ্তাহের?” সোহম জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, পারব। কিন্তু হঠাৎ অঙ্কিত?” অরিন্দম অবাক।
“আমার সন্দেহ ওর দিকে যাচ্ছে। কিন্তু নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলা যাবে না,” সোহম দৃঢ়ভাবে বলল।
“ঠিক আছে, পাঠাচ্ছি,” বললেন অরিন্দম।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই অরিন্দম মেইলে ডিটেইলস পাঠালেন। সোহম ডেটাগুলো ভালো করে বিশ্লেষণ করল। দেখে তার চোখ বড় হয়ে গেল।
অরুণিমার মৃত্যুর আগের রাতে অঙ্কিত বসুর ফোনের লোকেশন ছিল আইভি রেসিডেন্সি। আর সেই রাতে ফোনে বারবার কল করা হয়েছিল রঞ্জন বোসের নম্বরে।
সোহম এবার পরিষ্কার দেখতে পেল—অঙ্কিত বসু নিছক বন্ধু বা ম্যানেজার নয়। সে একটা বড় ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।
এই শেষ সূত্রটুকু নিয়ে এবার অঙ্কিতের মুখোমুখি হওয়ার সময় এসেছে। কিন্তু সোহম জানত, শুধু এই তথ্য দিয়ে অঙ্কিতকে কব্জা করা যাবে না। আরও সূক্ষ্মভাবে, বুদ্ধি দিয়ে ওকে ফাঁদে ফেলতে হবে।
বাইরে রাতটা আরও গভীর হয়ে এসেছে। সোহম জানত, এই রাতে আর ঘুম হবে না। সত্যিটাকে খুঁজে বের করতেই হবে—যে কোনো মূল্যে।
পরদিন সকাল। কলকাতার আকাশ তখনও মেঘে ঢাকা। সোহম জানত, অঙ্কিত বসুর মুখোমুখি হতে গেলে তাকে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে যেতে হবে। সামান্যতম ভুল করলেই অঙ্কিত ওর হাত থেকে বেরিয়ে যাবে। নিজের প্রতিটি পদক্ষেপ সাবধানে এগোতে লাগল সে।
প্রথমেই ফোন করল অঙ্কিত বসুকে। ফোনটা কয়েক সেকেন্ড পর ধরল অঙ্কিত, কণ্ঠে স্পষ্ট দ্বিধা, “হ্যালো?”
সোহম বন্ধুত্বপূর্ণ গলায় বলল, “অঙ্কিতদা, তোমার সঙ্গে একটু কথা বলার ছিল। একটু দেখা করা যাবে?”
“কী ব্যাপার?” অঙ্কিতের কণ্ঠে উদ্বেগ।
“কিছু তথ্য পেয়েছি, যা তোমার জানা দরকার। ব্যক্তিগতভাবে দেখা হলেই ভালো,” বলল সোহম।
“ঠিক আছে, কোথায় আসব?” কিছুটা ইতস্তত করে বলল অঙ্কিত।
“রবীন্দ্র সরোবর, আজ বিকেল চারটে,” সোহম জবাব দিল।
“ঠিক আছে, আসছি,” বলে ফোনটা কেটে দিল অঙ্কিত।
সোহম জানত, অঙ্কিতের মাথায় এবার চিন্তার ঝড় শুরু হবে। আর এই মানসিক চাপটাই তার প্রয়োজন ছিল।
বিকেল চারটে। রবীন্দ্র সরোবরের লেকের ধারে একটা নির্জন বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছে সোহম। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে দেখল, অঙ্কিত আসছে। চেহারায় উৎকণ্ঠা, চোখের নিচে স্পষ্ট কালো দাগ।
অঙ্কিত সামনে এসে চুপচাপ বসতেই সোহম হাসিমুখে বলল, “ধন্যবাদ আসার জন্য।”
“কী তথ্য পেয়েছ?” অঙ্কিত তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল।
সোহম সহজভাবেই বলল, “অরুণিমার মৃত্যুর আগে তুমি বেশ কয়েকবার রঞ্জন বোসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলে। কেন?”
অঙ্কিত মুহূর্তে ঘাবড়ে গেল, তারপর সামলে নিয়ে বলল, “ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল। কিছু অফিসিয়াল কাজ।”
“অফিসিয়াল কাজ?” সোহম ঠান্ডা স্বরে বলল, “কিন্তু তোমার ফোনের লোকেশন ছিল আইভি রেসিডেন্সি। যেখানে সেই রাতেই অরুণিমার মৃত্যু হয়।”
অঙ্কিতের মুখ এবার রক্তশূন্য হয়ে গেল। তবুও ও চেষ্টা করল সামলে নিতে, “হ্যাঁ, আমি ওখানে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেটা ওর মৃত্যুর অনেক আগেই। ওর সাথে কাজের কথা ছিল।”
“কিন্তু সিকিউরিটি ক্যামেরা বলছে, তুমি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ গিয়েছিলে। অথচ তুমি পুলিশকে এই তথ্যটা দাওনি কেন?” সোহম এবার সরাসরি আঘাত করল।
অঙ্কিত থতমত খেয়ে বলল, “আমি ভুলে গিয়েছিলাম।”
সোহম এবার আরও ঠান্ডা গলায় বলল, “তুমি সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলে কেন?”
“বেড়াতে গিয়েছিলাম,” দ্রুত জবাব দিল অঙ্কিত।
“বেড়াতে?” সোহম হেসে উঠল, “নাকি সেখানে সেই বিশেষ নিউরোলজিক্যাল হিপনোটিক ড্রাগটা সংগ্রহ করতে গিয়েছিলে?”
অঙ্কিতের মুখ মুহূর্তেই ছাই হয়ে গেল। তবুও সে শেষ চেষ্টা করল, “কী বলছ এসব? এসবের কোনো প্রমাণ আছে?”
“প্রমাণ?” সোহম শান্তভাবে একটা ছবি বের করে টেবিলে রাখল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, অঙ্কিত একটি সিঙ্গাপুরের হাই-টেক নিউরো-ল্যাবের সামনের রিসেপশনে দাঁড়িয়ে কারও সঙ্গে কথা বলছে। “এটা প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট?”
অঙ্কিতের হাত কাঁপতে শুরু করল। কণ্ঠে আতঙ্ক নিয়ে বলল, “তুমি… তুমি কোথায় পেলে এটা?”
“খুব কঠিন নয়,” সোহম বলল, “ক্লিনিকের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকেই নিয়েছি। ওদের ভিজিটর লিস্ট থেকেও তোমার নাম বেরিয়েছে।”
অঙ্কিত এবার মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলল, “আমি ওকে মারতে চাইনি। শুধু চাইছিলাম ও যেন সব ভুলে যায়। ও আমার সম্পর্কে এমন কিছু জেনে গিয়েছিল যা প্রকাশ পেলে আমার জীবন শেষ হয়ে যেত। রঞ্জন আমাকে বিপুল টাকা দিয়েছিল ওকে থামানোর জন্য। কিন্তু আমি হত্যা করিনি… বিশ্বাস করো…”
সোহম এবার কঠিন চোখে বলল, “তুমি সরাসরি না হলেও তোমার ওষুধই ওর মৃত্যুর কারণ। তোমার হিপনোটিক ড্রাগ ওর শরীরে এমন প্রভাব ফেলেছিল যে, অল্প ডোজেই ওর মৃত্যু হয়।”
অঙ্কিত মাথা নিচু করল। ফিসফিস করে বলল, “আমি জানতাম না, এতটা ক্ষতি হবে। ওকে আমি সত্যিই ভালোবাসতাম। ওর মুখোমুখি হওয়ার সাহস ছিল না বলে মুখ ঢেকে, নীল লেন্স পরে গিয়েছিলাম। আমি শুধু ওকে ভয় দেখিয়ে ওর স্মৃতি মুছে দিতে চেয়েছিলাম।”
সোহম দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। অঙ্কিতকে দেখে বলল, “তোমার মুখোশটা এবার খুলে গেছে। সত্যের মুখোমুখি হতে তৈরি হও।”
দূরে পুলিশের গাড়ি আসছে। অঙ্কিত চোখ বন্ধ করল। সোহম এবার জানত, সে শুধু সত্যিটাই প্রকাশ করেনি, বরং নিজের বুদ্ধির মাধ্যমেই একটা কঠিন রহস্যকে উন্মোচিত করেছে।
বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সোহম দেখল, কলকাতার আকাশে মেঘ সরে গিয়ে বিকেলের আলো ফুটছে। সত্যি কখনো আড়ালে থাকে না। আজ সেটাই আবার প্রমাণিত হলো।
অধ্যায় ১৪: রহস্যের শেষে—দ্বন্দ্বের শুরু
রবীন্দ্র সরোবরের সেই বেঞ্চটা থেকে অঙ্কিত বসুকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার পরেও সোহমের বুকের ভারটা যেন কমছিল না। কলকাতার আকাশ থেকে বৃষ্টির মেঘ সরে গেলেও, ওর মনে জমে থাকা মেঘগুলো তখনও কাটেনি। তদন্তের রহস্যটা শেষ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওর নিজের মনের ভেতর জন্ম নিয়েছে আরও গভীর একটা দ্বন্দ্ব।
কিছুক্ষণ পরে কাকা অরিন্দম এসে পাশে দাঁড়ালেন। পিঠে হাত রেখে বললেন, “ভালো কাজ করেছিস, সোহম। তোর বুদ্ধির জোরেই এই রহস্যটা সমাধান হয়েছে।”
সোহম ম্লান হেসে বলল, “কাকু, মামলাটা শেষ হয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু আমার মনে একটা জিনিস এখনও খচখচ করছে।”
“কী?” অরিন্দম জানতে চাইলেন।
সোহম গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “অঙ্কিত বসু ঠিকই বলেছে, ও হয়তো অরুণিমাকে হত্যা করতে চায়নি। কিন্তু সেই রাতের আগে থেকেই একটা বড় ষড়যন্ত্র তৈরি হচ্ছিল। রঞ্জন বোস, অতনু ঘোষাল, অভীক চ্যাটার্জী—এরা সবাই অরুণিমার মৃত্যুর পরোক্ষ কারণ। শুধু অঙ্কিতকে ধরে কি এই মামলার শেষ হবে?”
অরিন্দম একটু ভেবে বললেন, “তুই ঠিকই বলেছিস। কলকাতার অন্ধকার দিকটা আসলে এত সহজে শেষ হয় না। অরুণিমার মৃত্যুটা শুধু একটা কেস নয়, এটার পেছনে অনেকগুলো মুখোশ লুকিয়ে ছিল। একটা মুখোশ খুলেছে, কিন্তু আরও অনেক মুখোশ এখনো অক্ষত।”
সোহম শান্ত গলায় বলল, “কাকু, আমি চাই না এই তদন্ত এখানেই শেষ হোক। যে আসল অপরাধীরা অন্ধকারে বসে কলকাতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদেরও মুখোশ খুলতে হবে।”
অরিন্দম একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, “এটা খুব সহজ হবে না। তুই নিজেও তো দেখেছিস, কীভাবে প্রভাবশালী মহলের চাপ আসে।”
সোহম হেসে বলল, “আমি জানি। কিন্তু আমি এটাও জানি, সত্য কখনও চিরকাল চাপা থাকে না। কেউ না কেউ তাকে সামনে আনবেই। আমার লড়াইটা এখানেই শেষ হচ্ছে না। বরং এখান থেকেই শুরু হলো।”
অরিন্দম এবার বুঝলেন, তাঁর ভাইপো সত্যিই অনেক বড়ো লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়ে গেছে। তিনি গর্বিত হাসি নিয়ে বললেন, “আমি তোর সঙ্গে আছি। সামনে আরও অনেক কঠিন পথ আসবে, তুই পারবি?”
সোহম দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “পারতেই হবে। কারণ, একজন আইন পড়ুয়া হিসেবে এটা আমার শুধু কর্তব্যই নয়, দায়িত্বও। অরুণিমার মতো অনেক নিরীহ মানুষ আছে, যাদের কণ্ঠ কলকাতার ভিড়ে চাপা পড়ে যায়। তাদের জন্যই এই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।”
বিকেলের আলো তখন রবীন্দ্র সরোবরের জলে চিকচিক করছে। কলকাতার বাতাসে ভেসে আসছে হালকা শীতের আমেজ। অরিন্দম সোহমের কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “ঠিক আছে, নতুন কোনো কেস এলে তোমাকেই ডাকব।”
সোহম হাসল। তার হাসির পেছনে লুকিয়ে থাকা ক্লান্তিটা মুছে গেল সেই মুহূর্তেই। সত্যের জন্য লড়াই করতে সে প্রস্তুত—হোক না সেটা আরও কঠিন।
ফোনটা পকেটে বেজে উঠল। স্ক্রিনে দেখা গেল ছোট ভাই শুভ্রের নাম।
“হ্যাঁ, শুভ্র, বল,” সোহম হাসিমুখে বলল।
“দাদা, কেসটা শেষ হলো?” উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করল শুভ্র।
“শেষ? না রে ভাই, কেস তো সবে শুরু। আরও বড়ো কেস আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে,” সোহম আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল।
ফোন রেখে সোহম দেখল, কলকাতার সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে চারপাশটা যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠছে। “নীলচোখ” রহস্য শেষ হলেও, কলকাতার বুক জুড়ে অপেক্ষা করছে আরও কত শত রহস্য। তাকে সেই সব রহস্যের মুখোমুখি হতে হবে। তার নাম যে সোহম নন্দ, সত্যের অনুসন্ধান যার একমাত্র পথ।
শেষ হয়ে গেলেও রহস্য আসলে শেষ হয় না, সেটা সে ভালোভাবেই জানে।